দুষ্কৃতী দমনে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার। প্রশ্ন উঠছে ‘এনকাউন্টার’-এর ঘটনা নিয়েও। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
গত ৬ বছরে ১০,০০০ ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে উত্তরপ্রদেশে। সেই ঘটনায় ৬৩ জন দুষ্কৃতীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার এমনই দাবি করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের দেওয়া সরকারি তথ্যে।
উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসার পরই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের লক্ষ্য ছিল তাঁর সরকার অপরাধমূলক কাজ এবং দুষ্কৃতীদের বিষয়ে কোনও রকম আপস করবে না। রাজ্যকে অপরাধমুক্ত করতে তাই ঢালাও ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ-প্রশাসনকে।
রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে যোগীর সরকার মাফিয়া, দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নেয়। রাজ্যকে অপরাধমুক্ত করতে দুষ্কৃতীদের কড়া হাতে দমনের পথে হাঁটেন যোগী। তার পর থেকে একের পর এক ‘এনকাউন্টার’-এর ঘটনা ঘটতে থাকছে ওই রাজ্যে। সেই ‘এনকাউন্টারে’ কোনও দুষ্কৃতীর মৃত্যু হয়েছে, কেউ আহত অবস্থায় ধরা পড়েছেন। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকার অপরাধ সম্পর্কিত একটি তথ্য প্রকাশ করেছে। সেই তথ্য উদ্ধৃত করে এনডি টিভি জানিয়েছে, গত ৬ বছরে ১০,০০০ ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে। সেই ঘটনায় ৬৩ জন দুষ্কৃতীর মৃত্যু হয়েছে। এমনই দাবি করা হয়েছে ওই সরকারি তথ্যে।
যদিও সম্প্রতি লখনউ-এর এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) প্রশান্ত কুমার একটি সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেছিলেন, ‘‘পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ১৭৮ জন অভিযুক্ত মারা গিয়েছেন। এই এনকাউন্টারে আমাদের যে বাহাদুর সঙ্গীরা শহিদ হয়েছেন, তাঁদের সংখ্যা ১৫। ১৪২৫ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন। এই সব এনকাউন্টার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা মেনেই করা হয়েছে।’’
প্রয়াগরাজে উমেশ পাল হত্যাকাণ্ড নিয়ে গোটা উত্তরপ্রদেশে সরগরম। শুধু তাই-ই নয়, এই ঘটনায় পুলিশের ‘এনকাউন্টার’ দুই দুষ্কৃতীর মৃত্যু পরিস্থিতিতে আরও সরগরম করেছে। দুষ্কৃতীরা যে গাড়িতে এসে উমেশের উপর আক্রমণ করেন, তার চালক আরবাজ়কে প্রয়াগরাজে ‘এনকাউন্টার’-এ খতম করা হয়। তার পর পরই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় আর এক দুষ্কৃতী বিজয় কুমার ওরফে ওসমান চৌধুরীর। শুধু উমেশ হত্যাকাণ্ডই নয়, দুষ্কৃতী দমনে উত্তরপ্রদেশে মাঝেমধ্যেই এমন ‘এনকাউন্টার’-এর খবর পাওয়া যায়। যদিও বিরোধীরা যোগী সরকারের পুলিশের এই ‘এনকাউন্টার’ নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছে, আপত্তিও জানিয়েছে। কিন্তু দুষ্কৃতী দমনে যোগীর ‘এনকাউন্টাররাজ’ কায়েম রয়েছে গোটা উত্তরপ্রদেশে।
উত্তরপ্রদেশের পুলিশের একটি হিসাব বলছে, ৬ বছরে ১০,৫০০ ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে! শুধুমাত্র ২০২২-এর এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যেই ১,০৬৬টি ‘এনকাউন্টার’-এর ঘটনা ঘটেছে। আর ২০১৭-র মার্চ থেকে ২০২২-এর এপ্রিল, এই সময়ের মধ্যে ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে ৯,৪৩৪টি। আর এই ছ’বছরের মধ্যে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ১৭৮ জন দুষ্কৃতীর। সংঘর্ষে মারা গিয়েছেন ১৫ পুলিশকর্মীও। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে এমনই দাবি করা হয়েছে ‘দৈনিক ভাস্কর’-এর এক প্রতিবেদনে।
যোগী আদিত্যনাথের ‘ঠোক দো’ শব্দবন্ধ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল বহু আগে। অখিলেশ যাদবও যে সময় অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘‘যোগী কথায় কথায় বলেন, গুলি চালিয়ে দাও। পুলিশও তাঁর ‘ঠোক দো’ নীতি মেনে চলছে। তার জন্যই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।’’ প্রশ্ন উঠেছিল, এই সব ‘এনকাউন্টার’ ‘এক তরফা হত্যা’ নয় তো? কিন্তু উত্তরপ্রদেশ সরকার এবং পুলিশ সেই তত্ত্বে মান্যতা দেয়নি। তাদের বক্তব্য, যা হয়েছে, সবই যথাবিহিত বিধি মেনেই।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম দু’মাসেই পুলিশের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ৯টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ৬ বছরের মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ ‘এনকাউন্টার’-এর ঘটনা নিয়ে আবার জোর চর্চা শুরু হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হিসাব বলছে, ১০,৫০০ সংঘর্ষে দুষ্কৃতীদের গুলিতে ১৪০০ পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। অন্য দিকে, এই দু’পক্ষের সংঘর্ষে ২৩ হাজারের বেশি দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হিসাব আরও বলছে যে, ২০২২-এর ২৫ মার্চ থেকে ওই বছরের জুলাইয়ে, মাত্র তিন মাসের মধ্যে ৫২৫টি ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের পাঁচটি জ়োন রয়েছে যেখানে সবচেয়ে বেশি ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে। তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মেরঠ জ়োন। এই অঞ্চলে ৬৪টি ‘এনকাউন্টার’ হয়েছে। তার পর আগরা (১৯), বারাণসী (১৯), লখনউ (১১) এবং প্রয়াগরাজ (১০)। তবে শুধু উত্তরপ্রদেশই নয়, দেশের আরও ১০টি রাজ্যে ‘এনকাউন্টার’-এ মৃত্যুর সংখ্যাও খুব একটা কম নয়। ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে এক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কেন্দ্র সরকার জানিয়েছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে ছত্তীসগঢ়ে। ১৯১টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ (১১৭)। তৃতীয় স্থানে অসম (৩৫)।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বিরাগ গুপ্ত ‘এনকাউন্টার’ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ভারতের আইনব্যবস্থায় ‘এনকাউন্টারকে’ আইনগত বৈধতা দেওয়া হয়নি। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১ অনুযায়ী, জীবনের অধিকার হল মৌলিক অধিকার। আইনে বলা হয়েছে, সরকার কোনও ব্যক্তির জীবনযাপনের অধিকার একমাত্র আইনিপথেই হরণ করতে পারে। ‘এনকাউন্টার’ একটি নেতিবাচক বিষয়। সংবিধানে আইনের শাসনের কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ, কোনও দোষী ব্যক্তিকে আদালতের রায়ের পরই দোষী সাব্যস্ত করা যায়। আদালতেই তাঁর মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। যত ক্ষণ আদালতে কেউ দোষী সাব্যস্ত না হন, তত ক্ষণ তিনি নির্দোষ।
যদিও বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরপ্রদেশ সরকার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তার হিসাবের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্য মিলছে না। ফলে প্রশ্ন উঠছে, কোন তথ্য বেশি নির্ভরযোগ্য, তা নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy