প্রতীকী ছবি।
মোদী সরকার পেট্রল-ডিজ়েলে শুল্ক কমিয়ে রাজ্যগুলিকে ভ্যাট কমানোর আহ্বান জানানোর ২৪ ঘণ্টা পরেও কোনও বিরোধীশাসিত রাজ্য তাতে সাড়া দিল না। এক ডজন বিজেপি বা এনডিএ শাসিত রাজ্য ভ্যাট কমিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, মহারাষ্ট্র, কংগ্রেসশাসিত রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, পঞ্জাব বা বাম শাসিত কেরল— কোনও রাজ্যই সে পথে হাঁটেনি।
অধিকাংশ বিরোধীশাসিত রাজ্যের যুক্তি, কেন্দ্র উৎপাদন শুল্ক কমানোয় তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এমনিতেই রাজ্যের ভ্যাট কমছে। তার পরে আরও ভ্যাট কমাতে গেলে রাজ্যের কোষাগারে টান পড়বে। কিন্তু প্রতিটি রাজ্যেই বিজেপি ভ্যাট কমিয়ে সাধারণ মানুষকে আরও সুরাহা দেওয়ার দাবি তুলছে। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির পাল্টা যুক্তি, কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রল-ডিজ়েলে যে শুল্ক আদায় করছে, তার অতি সামান্য অংশই সে রাজ্যগুলির সঙ্গে ভাগ করে নেয়। শতকরা ৯৫ ভাগই নিজের ঝোলায় পোরে। তাই কেন্দ্রই আরও শুল্ক কমিয়ে আমজনতাকে সুরাহা দিক।
বিভিন্ন রাজ্যের লোকসভা ও বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পরেই বুধবার মোদী সরকার পেট্রল-ডিজ়েলে উৎপাদন শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। পেট্রলে লিটার প্রতি ৫ টাকা, ডিজ়েলে লিটারে ১০ টাকা করে শুল্ক কমানো হয়। বুধবার রাত থেকেই উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো বিজেপি বা এনডিএ শাসিত সরকারগুলি রাজ্যের ভ্যাট কমাতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১টি রাজ্য ও জম্মু-কাশ্মীরে ভ্যাট কমানো হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, পঞ্জাব, ছত্তীসগঢ়, কেরল, মহারাষ্ট্র— কোনও বিরোধীশাসিত রাজ্যই সে পথে হাঁটেনি।
কেন? রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌতের দাবি, কেন্দ্র ৫ ও ১০ টাকা করে শুল্ক কমানোয় এমনিতেই রাজ্যের ভ্যাট কমে যাচ্ছে। কারণ পেট্রল-ডিজেলের মূল দামের সঙ্গে পরিবহণ খরচ, কেন্দ্রের উৎপাদন শুল্ক যোগ করে যা হয়, তার উপরে শতকরা হারে রাজ্য ভ্যাট আদায় করে। কেন্দ্র ৫ ও ১০ টাকা শুল্ক কমানোয় রাজ্যের ভ্যাটও কমছে।
গহলৌতের এই যুক্তি যে ঠিক, তা কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রকের আধিকারিকরাও মানছেন। তাঁদের যুক্তি, উৎপাদন শুল্ক কমলে এমনিতেই রাজ্যের ভ্যাটের বোঝা কমে। তাই কেন্দ্র পেট্রলে ৫ টাকা শুল্ক কমানোয় পেট্রল পাম্পে জ্বালানির দাম ৫.৭০ টাকা থেকে ৬.৩৫ টাকা পর্যন্ত কমেছে। একই ভাবে ডিজ়েলে ১০ টাকা শুল্ক কমানোয় দাম কমেছে ১১.১৬ টাকা থেকে ১২.৮৮ টাকা পর্যন্ত। যে রাজ্যে ভ্যাটের হার যত বেশি, সেখানে দাম কমার মাত্রাও বেশি। রাজ্যগুলি ভ্যাটের হার না কমালেও তাদের রাজস্ব আয় কমছে।
গহলৌতের যুক্তি, ভ্যাট আদায় কমার ফলে রাজস্থান সরকারের বছরে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা লোকসান হবে। তার উপরে রাজ্যকেও ভ্যাটের হার কমাতে হলে রাজস্ব ক্ষতির অঙ্ক আরও বাড়বে। গহলৌতের দাবি, কেন্দ্র আরও শুল্ক কমাক। তাতে রাজ্যের ভ্যাট বাবদ আয় আরও কমলেও মানুষের স্বার্থে তিনি তা মেনে নিতে রাজি।
কেরলের অর্থমন্ত্রী কে এন বালগোপাল জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সরকারের পক্ষে ভ্যাট কমানো সম্ভব নয়। কারণ তাতে উন্নয়নে খরচ কমাতে হবে। বালগোপালের অভিযোগ, কেন্দ্র অনেকখানি শুল্ক বাড়িয়ে এখন উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে নির্বাচনের আগে ৫-১০ টাকা শুল্ক কমিয়ে মুখ রক্ষা করছে। আসলে মোদী সরকার আমজনতার চোখে ধুলো দিতে চাইছে। বালাগোপালের দাবি, মোদী সরকার বছরের পর বছর তেলে শুল্ক বাড়ালেও তার মধ্যে সেস, অতিরিক্ত শুল্কের ভাগ বাড়িয়েছে। যার পুরো আয়টাই কেন্দ্রের কাছে থাকে। রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হয় না। রাজ্যের সঙ্গে যে অংশটা ভাগ করে নিতে হয়, সেই মূল উৎপাদন শুল্ক বা বেসিক এক্সাইজ় ডিউটির পরিমাণ ক্রমশ কমেছে।
বিরোধীদের ব্যাখ্যা, গত কাল শুল্ক কমানোর আগে পর্যন্ত কেন্দ্র পেট্রলে ৩২.৯০ টাকা আদায় করত। এর মধ্যে বেসিক এক্সাইজ ডিউটির পরিমাণ মাত্র ১.৪০ টাকা। ওই ১.৪০ টাকার মাত্র ৪১ শতাংশ, অর্থাৎ মাত্র ৫৭ পয়সা কেন্দ্র সব রাজ্যের মধ্যে বিলি করে। বিশেষ অতিরিক্ত শুল্ক, কৃষি সেস, সড়ক-পরিকাঠামো সেস বাদে বাকি ৩১.৫০ টাকার পুরোটাই কেন্দ্রের ঝোলায় যাচ্ছিল। ৫ টাকা শুল্ক কমায় এখন থেকে ২৬.৫০ টাকা কেন্দ্রের কোষাগারে যাবে।
একই ভাবে ডিজ়েলে যে ৩১.৮০ টাকা হারে শুল্ক আদায় হচ্ছিল, তার মধ্যে মাত্র ১.৮০ টাকা বেসিক এক্সাইজ় ডিউটি। এর মধ্যে মাত্র ৭৪ পয়সা কেন্দ্র রাজ্যগুলির মধ্যে বিলি করত। বাকি ৩০ টাকাই কেন্দ্রের ঘরে যেত। ১০ টাকা শুল্ক কমায় এখন থেকে ২০ টাকা কেন্দ্রের ঘরে যাবে।
বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী সরকার বছর বছর জ্বালানিতে শুল্ক আদায়ে রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার অংশ কমিয়েছে। গত অর্থ-বছরেও পেট্রল-ডিজ়েলে মূল উৎপাদন শুল্কের পরিমাণ ছিল ২.৯৮ টাকা ও ৪.৮৩ টাকা। গত ফেব্রুয়ারির বাজেটে তা আরও কমিয়ে ১.৪০ টাকা ও ১.৮০ টাকা করে দেওয়া হয়। বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির অভিযোগ, অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রের রাজস্ব বাবদ আয়ের ৪১ শতাংশ রাজ্যগুলির মধ্যে বিলি হওয়ার কথা। কিন্তু মোদী সরকার গত সাত বছরে সেস বসিয়ে কেন্দ্রের রাজস্ব বাবদ আয়ের অনেকটাই নিজের কাছে রাখছে। রাজ্যগুলির মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার অংশ কমছে। চলতি বছরের বাজেটে কেন্দ্র কর বাবদ ২২.১৭ লক্ষ টাকা আয়ের লক্ষ্য রেখেছে। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ৬.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা রাজ্যগুলির মধ্যে বিলি হবে। যা কেন্দ্রের আয়ের মাত্র ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থ কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে কেন্দ্র নিজের আয়ের ৪১ শতাংশের বদলে মাত্র ২৯ শতাংশ রাজ্যগুলিকে বিলি করছে। কেন্দ্র থেকে পাওয়া অর্থ কমে যাওয়ায় রাজ্যগুলির পক্ষে পেট্রল-ডিজ়েলে ভ্যাট কমানোও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী সরকার আসলে উপনির্বাচনের ফলাফলে ভয় পেয়ে জ্বালানিতে শুল্ক কমিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি ভ্যাট কমিয়ে আশা করছে, আসন্ন নির্বাচনের আগে মানুষের ক্ষোভে প্রলেপ দেওয়া যাবে। কিন্তু কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরার দাবি, “মন থেকে নয়, এটা ভয় থেকে সিদ্ধান্ত। তোলাবাজ সরকারের লুটের জবাব মানুষ আগামী নির্বাচনেও দেবে।”
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রের শুল্ক কমানোটা আসলে উপনির্বাচনের প্রভাব। চড়া শুল্কের জন্যই যে তেলের দাম বেশি, আমাদের সেই অভিযোগ প্রমাণিত হল। কেন্দ্রীয় সরকারের লোভের জন্যই যে শুল্কের হার বেশি ছিল, সেই অভিযোগও প্রমাণ হল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy