গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
দিনভর টানাপড়েনের পরে অবশেষে অষ্টাদশ লোকসভার স্পিকার পদের ভোটাভুটিতে কংগ্রেস সাংসদ কোড়িকুন্নিল সুরেশকে সমর্থনের বার্তা দিল তৃণমূল। মঙ্গলবার রাতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের বাড়িতে বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে সর্বসম্মত ভাবে সুরেশকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তৃণমূলের লোকসভার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যসভা নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন হাজির ছিলেন ওই বৈঠকে।
তবে স্পিকার পদে কংগ্রেসের মনোনয়ন মেনে নিলেও নতুন লোকসভার অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, বিরোধী জোটের বৃহত্তম দল কংগ্রেস হলেও তাদের কোনও একতরফা সিদ্ধান্ত মানা হবে না। বস্তুত, স্পিকার পদে সুরেশকে প্রার্থী ঘোষণা করার আগে তাঁদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি বলে সংসদ ভবন চত্বরে দাঁড়িয়ে সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মঙ্গলবার রাতে খড়্গের বাড়িতে ‘ইন্ডিয়া’র ওই বৈঠকেই লোকসভার বিরোধী দলনেতা পদে রাহুল গান্ধীর নাম সর্বসম্মত ভাবে অনুমোদন পেয়েছে। কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেত্রী সনিয়া গান্ধী মঙ্গলবারই লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা পদে রাহুলকে মনোনীত করার সিদ্ধান্তের কথা লোকসভার প্রোটেম স্পিকার ভর্তৃহরি মহতাবকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন বলে এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপালের দাবি।
লোকসভার পাটিগণিত অবশ্য বলছে বুধবার বেলা ১১টায় স্পিকার পদে ভোটাভুটিতে শাসক জোটের প্রার্থী তথা বিগত লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার জয় নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে স্পিকার পদে পুনর্নির্বাচিত হয়ে প্রয়াত বলরাম ঝাখরের নজির স্পর্শ করবেন ওম। ঘটনাচক্রে, ওই পদে বসলে ঝাখরের মতোই ওমও হবেন রাজস্থান থেকে নির্বাচিত সাংসদ, যিনি উপর্যুপরি দ্বিতীয় বার স্পিকার পদে আসীন হবেন।
কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’তে ক্ষুব্ধ অভিষেক
মঙ্গলবার লোকসভা স্পিকার মনোনয়ন নিয়ে যখন রাজধানী দিল্লি সরগরম, তখনই সংসদ চত্বরে দাঁড়িয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘কংগ্রেসের তরফে সাংসদ কে সুরেশকে স্পিকার পদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, বিরোধী জোটের সমস্ত শরিকদের সঙ্গে কথা না বলেই। এ ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি এই সিদ্ধান্ত একতরফা ভাবে নেওয়া হয়েছে।’’
যদিও এই কথা বলার কিছু পরেই অভিষেককে দেখা যায় সংসদের ভিতরে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে। তবে সেই আলোচনার পরে রাহুল আলাদা করে অভিষেকের বক্তব্যের কোনও জবাব দেননি। অভিষেকও নতুন করে কিছু বলেননি। এর পরে তৃণমূলের একটি সূত্রে জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ দলীয় নেতৃত্ব দিল্লিতে বৈঠকে করেন। কথা হয় নেত্রী মমতার সঙ্গেও। তার পরে রাতে খড়্গের বাড়িতে ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আগামী দিনে কংগ্রেসের ‘দাদাগিরি’ যে বরদাস্ত করা হবে না, অভিষেকের মন্তব্যেই তার স্পষ্ট বার্তা রয়েছে বলে দলের ওই সূত্রের দাবি।
স্পিকার নিয়ে এ বার ভোট
সাধারণ ভাবে লোকসভার স্পিকার সর্বসম্মতিতেই নির্বাচিত হয়। কিন্তু এ বার তা ভোটাভুটিতে গড়াতে চলেছে। বস্তুত, স্পিকার পদ নিয়ে সকাল থেকে দিল্লিতে শুরু হয় এনডিএ-বনাম কংগ্রেসের বাগ্যুদ্ধ। এক দিকে এনডিএ-র দাবি, লোকসভা স্পিকার নির্বাচন নিয়ে অযথা রাজনীতি করছে কংগ্রেস-সহ বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’। অন্য দিকে, কংগ্রেস সাংসদ রাহুল দাবি করেন, শাসক গোষ্ঠী এনডিএ-র মনোনীত স্পিকারকে সমর্থন করতে তাঁরা রাজি হবেন তখনই, যখন সরকার তাঁদের শর্তটি মেনে নেবে।
কী সেই শর্ত? রাহুল জানান, লোকসভার রেওয়াজ হল, ডেপুটি স্পিকার বিরোধী শিবির থেকে বাছতে হবে। সেই রেওয়াজ মানতে হবে এনডিএ সরকারকেও। যদি তা না হয়, তবে এনডিএ-র মনোনীত স্পিকারকে বিরোধীরা সমর্থন করবে না। অতীতে ভিপি সিংহ, পিভি নরসিংহ রাও, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় স্বীকৃত বিরোধীরাই ডেপুটি স্পিকারের পদ পেয়েছে। মোদীর জমানার প্রথম দু’বার স্বীকৃত বিরোধী দলের মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি কোনও বিরোধী দল।
কিন্তু এ বার ৯৯ আসনে জিতে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার রাহুল দাবি করেন, রাজনাথ সিংহ সরকারের তরফে এ ব্যাপারে দরাদরি করতে এসেছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের সঙ্গে। কিন্তু বিরোধীদের শর্ত শোনার পরে তিনি আর এ ব্যাপারে কোনও সমাধানসূত্রে পৌঁছনোর চেষ্টা করেননি। এ ব্যাপারে আর ফোনই করেননি খড়্গেকে।
যদিও রাজনাথ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এনডিএ-ও রাজনাথের হয়ে বলে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী চেয়েছিলেন স্পিকার নির্বাচনের পরে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু কংগ্রেস তাতে রাজি হয়নি। এ পর্যন্ত রাহুলের বক্তব্য নিয়ে ‘ইন্ডিয়া’র কোনও শরিকই আপত্তি তোলেননি। গোল বাধে স্পিকার নির্বাচনে আচমকাই কংগ্রেসও আলাদা করে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করার পরে। অভিষেক কংগ্রেসের একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
স্পিকার ভোটের আগেও শপথ
মঙ্গলবার শপথ নিয়েছেন লোকসভায় তৃণমূলের ২৯ জন জয়ী প্রার্থীর মধ্যে ২৬ জন। শপথ নেননি তৃণমূলের তিন জন। সেই তালিকায় রয়েছেন বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের হাজি নুরুল ইসলাম, ঘাটালের দীপক অধিকারী (দেব) এবং আসানসোল লোকসভার শত্রুঘ্ন সিন্হা। বুধবার স্পিকার নির্বাচনের আগেই নিয়ম মেনে শপথ নিতে হবে তাঁদের। তা না হলে ভোটাভুটিতে তাঁরা অংশ নিতে পারবেন না।
বিরোধী দলনেতা হচ্ছেন রাহুল
অষ্টাদশ লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হচ্ছেন রাহুল গান্ধী। মঙ্গলবার রাতে দিল্লিতে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে এ বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেত্রী সনিয়া গান্ধীজি লোকসভার প্রোটেম স্পিকারকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, রাহুল গান্ধীকে বিরোধী দলনেতা পদে মনোনীত করা হয়েছে।’’
গত ৮ জুন দিল্লিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত বৈঠকে আনুষ্ঠানিক ভাবে রাহুলকে লোকসভার দলনেতা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ২০১৪ সালে ৪৪ এবং ২০১৯-এ ৫২টি আসনে জেতা কংগ্রেস এ বার লোকসভা নির্বাচনে ৯৯টি আসন জিতে ‘প্রধান বিরোধী দল’-এর মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছে। এক দশক পরে লোকসভায় ফিরতে চলেছে ‘বিরোধী দলনেতা’ পদ। ফলে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হলে রাহুল ‘বিরোধী দলনেতা’ হবেন।
এ বারের লোকসভা ভোটে কেরলের ওয়েনাড় এবং উত্তরপ্রদেশের রায়বরেলী— দু’টি আসন থেকেই সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন রাহুল। এই পরিস্থিতিতে তাঁকে বিরোধী দলনেতা করার জন্য কংগ্রেসের অন্দরে জোরালো দাবি উঠেছিল বলে দলের একটি সূত্র জানিয়েছে। মঙ্গলবার ‘ইন্ডিয়া’র বৈঠকে কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এনসিপি, আরজেডি-সহ বিরোধী জোটের বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা হাজির ছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy