Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
One Nation One Election

ভোটের ভবিষ্যৎ! ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বিল পেশ করতেও বাধা লোকসভায়! ভোটাভুটিতে মিলল ছাড়পত্র

বিলের পক্ষে ভোট দিলেন সরকার পক্ষের ২৬৯ জন সাংসদ। বিপক্ষে ১৯৮ জন। ভোটাভুটির পরে এক ঘণ্টার জন্য মুলতুবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন।

কেন জোটের সাংসদদের একাংশ গরহাজির ছিলেন, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বিজেপি।

কেন জোটের সাংসদদের একাংশ গরহাজির ছিলেন, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বিজেপি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ২২:৫৯
Share: Save:

সূচনা পর্বেই মিলল সংঘাতের বার্তা! শেষ পর্যন্ত বিরোধী পক্ষের তোলা ‘ডিভিশনের’ দাবি মেনে ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশ নিয়ে মঙ্গলবার ভোটাভুটি হল লোকসভায়। বিলের পক্ষে ভোট দিলেন সরকার পক্ষের ২৬৯ জন সাংসদ। বিপক্ষে ১৯৮ জন। ভোটাভুটির পরে এক ঘণ্টার জন্য মুলতুবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন। লোকসভায় শাসকজোটের বিধায়ক সংখ্যা ২৯৩। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে, কেন জোটের সাংসদদের একাংশ গরহাজির ছিলেন, তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বিজেপি।

মঙ্গলবার ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশের জন্য প্রথমে ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম’ এবং তার পরে ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাভুটি হয়। এই প্রথম নতুন সংসদ ভবনে ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম’ ব্যবহার করা হল। তার আগে বিরোধীদের আপত্তির মাঝেই মঙ্গলবার লোকসভায় ‘এক দেশ এক ভোট’ সংক্রান্ত বিল পেশ করে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল এ সংক্রান্ত ১২৯তম সংবিধান সংশোধনী বিল এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন (সংশোধনী) বিল সংসদের নিম্নকক্ষে পেশ করেন। এর পরে কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল জোড়া বিল নিয়ে ডিভিশনের দাবি তোলে। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় বিধি মেনে কোনও বিল নিয়ে বিতর্কের আগে ভোটাভুটি করতে হয়।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মঙ্গলবার জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘এক দেশ এক ভোট’ বিলের খসড়া নিয়ে সংসদের যৌথ কমিটিতে আলোচনা চান। বিরোধী সাংসদদের বক্তব্য, এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোতেই আঘাত হানবে। এর মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে। তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এই বিল সংবিধানের মূল কাঠামোই আঘাত করবে। বিজেপি কী ভাবে এই বিল লোকসভায় পাশ করাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ডিএমকে। স্ট্যালিনের দলের সাংসদ টিআর বালুর বক্তব্য, “এই সরকারের যখন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই নেই, তারা কিসের ভরসায় এই বিল পেশ করছে সংসদে?” আপত্তি জানান মিম সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসিও।

‘ভোটের’ ভবিষ্যৎ—

মঙ্গলবার ভোটাভুটির মাধ্যমে লোকসভায় পেশ হলেও ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল এখনও সংসদের নিম্নকক্ষে পাশ হয়নি, বিল দু’টি কবে আইনে পরিণত হবে, কবে থেকে কার্যকর হবে, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। যদি কোনও পরিবর্তন বা সংশোধনী ছাড়া বিল দু’টি সংসদে পাশ হয়ে যায়, তা হলে ‘এক দেশ, এক ভোট’ ২০৩৪ সাল থেকে কার্যকর করা যেতে পারে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত এই বিল পাশ করাতে সংসদের দু’কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার প্রয়োজন নরেন্দ্র মোদী সরকারের। বর্তমান পরিস্থিতিতে লোকসভা বা রাজ্যসভা কোনও কক্ষেই সরকারের হাতে তা নেই।

বিরোধীরা আপত্তি জানাতে পারে, তা আঁচ করে কেন্দ্র আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল বিল দু’টি সংসদের যৌথ কমিটিতে (জয়েন্ট কমিটি অফ পার্লামেন্ট) পাঠানো হবে। সেই মতো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই বিল দু’টি ওই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মেঘওয়ালকে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীও জানান, বিল দু’টি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য তাঁরা সংসদের যৌথ কমিটিতে এই বিল পাঠাতে চান।

এ ক্ষেত্রে যৌথ কমিটিতে কোন দলের কত জন সদস্য থাকবেন, তা নির্ভর করে লোকসভায় ওই দলের মোট সাংসদের উপর। সূত্রের খবর, এই যৌথ কমিটির মেয়াদ থাকতে পারে ৯০ দিন। পরে প্রয়োজন হলে তা বৃদ্ধি করা হতে পারে। বিল দু’টিতে কোথাও কোনও সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজনের প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা বিবেচনা করে দেখবে এই কমিটি। এর পরে বিল দু’টি নিয়ে ভোটাভুটি হবে লোকসভায়। পাশ হলে তা রাজ্যসভায় পাঠানো হবে। সেখানে পাশ হলে, পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কাছে।

এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ২০৩৪ সালের আগে এক ভোটের আইন কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, কোবিন্দ কমিটির সুপারিশে একটি ‘অ্যাপয়েন্টেড ডেট’-এর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচনের পর নতুন লোকসভার প্রথম অধিবেশনের সময়ে রাষ্ট্রপতি একটি নির্দিষ্ট দিনের কথা ঘোষণা করবেন। ওই দিনের পর থেকে গঠিত রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ লোকসভার সঙ্গেই শেষ হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন লোকসভা গঠন হবে ২০২৯ সালে। তার পরে রাষ্ট্রপতি ‘অ্যাপয়েন্টেড ডেট’ ঘোষণা করবেন। ফলে ২০৩৪ সালের আগে এই বিল কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। যদি ২০২৯ সালের লোকসভা গঠনের পর রাষ্ট্রপতি এই দিন ঘোষণা করেন, তবে ওই তারিখের পর যে রাজ্য সরকারগুলি গঠিত হবে, সেগুলির মেয়াদ লোকসভার মেয়াদের সঙ্গেই শেষ হবে। এ ক্ষেত্রে অনেক রাজ্যের বিধানসভা পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ না-ও পেতে পারে।

‘এক ভোট’ বিলের ইতিহাস—

সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের মাঝেই গত ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘এক দেশ এক ভোট’ সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট অনুমোদিত হয়েছিল। ‘এক দেশ এক ভোট’ কার্যকরের দিশানির্দেশিকা খুঁজতে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি গড়েছিল মোদী সরকার।

লোকসভা ভোটের আগেই গত ১৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে গিয়ে একসঙ্গে লোকসভা এবং সব ক’টি বিধানসভার নির্বাচন করানোর সুপারিশ করে আট খণ্ডে বিভক্ত ১৮ হাজার পাতার রিপোর্টটি জমা দিয়েছিল কোবিন্দ কমিটি। সেখানে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ কমিটির অন্য সদস্যেরা।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করে বলেছিলেন, বিভিন্ন মঞ্চে আলোচনার পরেই কোবিন্দ কমিটির রিপোর্ট অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে তাঁর ইঙ্গিত ছিল, সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি পেশ করা হতে পারে। এ বিষয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মতামত নিয়েছে মোদী সরকার।

বিরোধীদের অভিযোগ—

কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম-সহ বিরোধী দলগুলি গোড়া থেকেই ‘এক দেশ এক ভোট’ পদ্ধতির সমালোচনায় মুখর। তাদের মতে, এই নীতি নিয়ে মোদী সরকার ঘুরপথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থী বলেও বিরোধী নেতৃত্বের অভিযোগ। বিশেষত বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির আশঙ্কা, ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে লোকসভার ‘ঢেউয়ে’ বিধানসভাগুলি ‘ভেসে যাবে’।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয়, সাংসদ এবং বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেটুকু বৈচিত্রের সম্ভাবনা রয়েছে, বিজেপির আগ্রাসী প্রচারের মুখে তা ভেঙে পড়বে বলে অভিযোগ করেছে কংগ্রেস। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, বিজেপির অঙ্ক হল, শুধু লোকসভা ভোট হলে বিরোধী দলগুলির পক্ষে আসন সমঝোতা করা সহজ হবে। কিন্তু একই সঙ্গে বিধানসভা ভোট জুড়ে দিতে পারলে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলির বিরোধ অনিবার্য। বিরোধীদের একাংশের আশঙ্কা, পরবর্তী পর্যায়ে এই নীতিতে হেঁটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনগুলিকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে দিয়ে পঞ্চায়েত-পুরসভা ভোটকেও এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তা ছাড়া, ‘এক ভোট’ ব্যবস্থা চালুর পরে কেন্দ্রে বা কোনও রাজ্যে পাঁচ বছরের আগেই নির্বাচিত সরকার পড়ে গেলে কী হবে, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও।

মোদী সরকারের যুক্তি—

লোকসভা ভোটের সঙ্গেই সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট সেরে ফেলার পক্ষে মোদী সরকারের যুক্তি হল, এতে নির্বাচনের খরচ কমবে। একটি ভোটার তালিকাতেই দু’টি নির্বাচন হওয়ায় সরকারি কর্মীদের তালিকা তৈরির কাজের চাপ কমবে। ভোটের আদর্শ আচরণ বিধির জন্য বার বার সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে থাকবে না। নীতি আয়োগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশনও এই ভাবনাকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছে বলে কেন্দ্রের যুক্তি।

কারা সমর্থক, কারা বিরোধী—

কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, শিবসেনা (উদ্ধব), এনসিপি (শরদ), আরজেডি, জেএমএম, বাম-সহ ‘ইন্ডিয়া’র সব সহযোগী দল ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিলের বিরোধিতা করছে। অন্য দিকে, এনডিএ সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ শরিক দল, চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি এবং নীতীশ কুমারের জেডিইউ মঙ্গলবার এই বিলে সমর্থন জানিয়েছে। শিবসেনা (শিন্ডে) শিবিরও বিলে সম্মতি জানিয়েছে। শিন্ডে-পুত্র শ্রীকান্ত শিন্ডের বক্তব্য, গত ছ’মাস ধরে কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধী দলগুলি সব কিছুকেই ‘অসাংবিধানিক’ বলে দাগাতে চাইছে।

ওড়িশায় বিজেপির হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বিজেডির রাজ্যসভার সাংসদ সস্মিত পাত্র জানান, বিলে সমর্থন জানানো হবে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে তিনি বলেন, “লোকসভায় আমাদের কোনও সাংসদ নেই। বিলটি যখন রাজ্যসভায় আসবে, তখন আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।” লোকসভায় সাংসদ না থাকলেও রাজ্যসভায় বিল নিয়ে ভোটাভুটিতে বিজেপির পাশে থাকতে পারে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেস।

অন্য বিষয়গুলি:

One Nation One Election Amit Shah Narendra Modi Central Government Vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy