Advertisement
২৪ অক্টোবর ২০২৪
Linocut by Nandalal Bose

সংসদ ভবনে আলমারির মাথায় অবহেলায় ‘দাঁড়িয়ে’ নন্দলালের আঁকা সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গফ্ফর খান

১৯৩৬ সালে নন্দলাল বসুর লিনোকাটে (ছাপা ছবি) সীমান্ত গান্ধীর এই অমূল্য প্রিন্টটি আলমারির মাথায় কোনও মতে হেলান দিয়ে রাখা। ধুলো ছাড়াও যার উপরে চুনকামের রং গড়িয়ে পড়েছে।

নন্দলাল বসুর সেই লিনোকাট।

নন্দলাল বসুর সেই লিনোকাট। ছবি: সাংসদ জহর সরকার সূত্রে প্রাপ্ত।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৪ ০৮:১৩
Share: Save:

ইতিহাসকে আঁকড়ে আগের তুলনায় নিঝুম দাঁড়িয়ে পুরনো সংসদ ভবন (সংবিধান সদন)। তার করিডরে প্রহরীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখার রংচটা কাঠের আলমারির মাথায় অবহেলায় ‘দাঁড়িয়ে’ সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফ্ফর খান। ১৯৩৬ সালে নন্দলাল বসুর লিনোকাটে (ছাপা ছবি) সীমান্ত গান্ধীর এই অমূল্য প্রিন্টটি আলমারির মাথায় কোনও মতে হেলান দিয়ে রাখা। ধুলো ছাড়াও যার উপরে চুনকামের রং গড়িয়ে পড়েছে। সীমান্ত গান্ধীকে নিয়ে আঁকা সীমিত সংখ্যক নন্দলালের এই লিনোকাটেরই আর একটি প্রিন্ট সম্প্রতি লন্ডনের ক্রিস্টি’স-এর নিলাম ঘরে বিক্রি হয়েছে ১০ হাজার ৬২৫ ডলারে! নন্দলালের পরিবারসূত্রে প্রাপ্ত এই ছবির আর একটি প্রিন্ট রয়েছে ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট-এ। তৃতীয়টি কবে সংসদে আনা হয়েছিল, সেই বিষয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অতীত জানা না-গেলেও এর বর্তমান অবস্থা যে অত্যন্ত করুণ, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই।

বিষয়টি এই অধিবেশন চলাকালীন প্রথম চোখে পড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার সাংসদ প্রতিমা মণ্ডলের। সাধারণত পুরনো ভবনে সাংসদেরা আসেন না। কিন্তু তৃণমূল যেহেতু এখনও নতুন ভবনে ঘর পায়নি, তাই সংবিধান সদনে তাঁদের পুরনো দলীয় অফিসে দুপুরে এসে স্বাক্ষর করেন দলীয় সাংসদেরা। যাতায়াতের পথে এই ছবির এমন হাল দেখে চক্ষু চড়কগাছ প্রতিমার। আজ লোকসভায় শিক্ষা মন্ত্রকের বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে আলোচনায় বলতে উঠে প্রতিমা এই অবহেলার কথা তুলেছেন। তাঁর কথায়, “পুরনো ভবনের করিডরে নোটিস অফিসের একেবারে সামনেই একটি ভাঙাচোরা কাঠের আলমারির মাথায় নন্দলাল বসুর আঁকা একটি ছবি রয়েছে। যিনি ভারতীয় চিত্রকলার পথপ্রদর্শক, কলা ভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ। এই সরকার ওই ছবিকে সম্মান দিতে পারেনি। তার উপরে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে। এত বড় সদনে যদি তা রাখার জায়গা না দিতে পারেন, তা হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দিন। আমরা সম্মান দিয়ে রাখব।” নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁর বক্তব্যের মাঝেই প্রতিমাকে বার বার থামতে বলা হয়। তাঁর বক্তব্যের পাঁচ ঘন্টা পরেও ছবিটিকে ওই ভাবেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যে আলমারিটার উপরে তা রাখা হয়েছে, তা মাঝে মাঝেই খুলে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁদের প্রয়োজনীয় জিনিস রাখছেন বা বার করেছেন।

তৃণমূলের সাংসদ তথা সংস্কৃতি মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব জহর সরকারের কথায়, “এই অবহেলা অনিবার্য ছিল। এই সরকারে প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর কোনও মন্ত্রী সংস্কৃতি বোঝেন বলে আমাদের জানা নেই। তাঁদের কাছে নন্দলাল আর রামলাল আগরওয়ালের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। ভারতের ঐতিহ্যপূর্ণ সংসদ ভবন হঠাৎ পরিত্যাগ করে নরেন্দ্র মোদী তাঁর নিজের অমরত্বের লক্ষ্যে নতুন ভবনে জোর করে সংসদ স্থানান্তরিত করেন। তখন কোনও পরিকল্পনাই করা হয়নি। অথচ এই পুরনো ভবনে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার শিল্পকলার কাজ ছড়িয়ে রয়েছে। ওঁদের সাংস্কৃতিক অজ্ঞতা আর অবহেলার জন্যে এই সব অমূল্য জিনিসগুলি চুরি হতে বা ধ্বংস হতে বেশি দিন লাগবে না।”

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক-প্রিন্টমেকিং বিভাগের অধ্যাপক এবং গ্রাফিক শিল্পী পরাগ রায়ের কথায়, “নন্দলালের এই আব্দুল গফ্ফর খানের ছবিটি আমাদের ছাপাই ছবির ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। সেটি সংসদ ভবনে এত অযত্নে আছে শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।” তাঁর কথায়, “যে কোনও ছাপাই ছবিতে শিল্পী নিজে হাতে কাঠ, ধাতুর পাত বা লিনোলিয়ামে খোদাই করে ছবি রচনা করে নিজেই তার ছাপ নেন। এই ছাপ সাধারণত সীমিত সংস্করণের হয়। ওই নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাপ, তা পাঁচ বা ১০ যা-ই হোক না কেন, প্রতিটিতে শিল্পীর স্বাক্ষর থাকে এবং প্রত্যেকটিকেই ‘অরিজিনাল’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সংস্করণের কাজ শেষ হলে ওই ব্লকটি শিল্পী নষ্ট করে ফেলেন। ওই নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্লক বা প্লেটের একটি ছাপ তোলার নিয়মকে ‘ক্রস প্রিন্ট’ বলা হয়। তবে নন্দলালের সময়ে বা গত শতকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকে ছাপাই ছবির এত নিয়ম না-থাকারই কথা। তাই খান আব্দুল গফ্ফর খানের কতগুলি প্রিন্ট তিনি তৈরি করেছিলেন, তা আজ অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া জানা বোধহয় সম্ভব নয়।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে ফরাসি শিল্পী অঁদ্রে কারপ্লেজ় শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কলা ভবনের অতিথি শিল্পী হিসেবে। বলা যেতে পারে যে, তাঁর কাছেই নন্দলাল বসু ও তাঁর শিষ্যদের লিনোকাট মাধ্যমে হাতেখড়ি । পরবর্তী কালে নন্দলাল সহজ পাঠের অলঙ্করণে এই লিনোকাট ব্যবহার করেন। এ ছাড়া মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী ও সীমান্ত গান্ধীকে নিয়ে তৈরি তাঁর লিনোকাটগুলিও ভারতের ছাপচিত্রের ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ।

লিনোলিয়াম মূলত এক ধরনের কৃত্রিম আচ্ছাদন যা ঘরের মেঝে ঢাকতে ব্যবহার হয়। এর মূল উপাদান কর্কের গুঁড়ো, লিনসিড অয়েল, কাঠের গুঁড়ো, রজন, চট প্রভৃতি। বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকে আধুনিক শিল্পীরা এই লিনোর চাদরকে খোদাই করে চিত্র রচনার পরে তার ছাপ নিতেন। কাঠের ব্লকের পাশাপাশি লিনোলিয়ামে ছাপাই শিল্পীদের প্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে। পাবলো পিকাসো এক সময়ে এই মাধ্যমে বহু ছবি রচনা করেছেন। যা আজ বিশ্ব শিল্প কলার সম্পদ।

অন্য বিষয়গুলি:

Nandalal Bose Jawhar Sircar parliament
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE