জয়ী: ৪ অপরাধীর ফাঁসির পরে নির্ভয়ার মা-বাবা। নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
১০, ৯, ৮...৪, ৩...। ঘড়ির কাঁটা ঠিক সাড়ে ৫টা ছুঁতেই কাউন্টডাউন শেষ করা ভিড় সমস্বরে গর্জে উঠল— ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি! অবশেষে বিচার পেলেন নির্ভয়া। ক্যালেন্ডার বলছে ২৬৫১ দিন পরে!
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বন্ধুর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে দিল্লিতে চলন্ত বাসের মধ্যে ধর্ষিতা হন নির্ভয়া। গণধর্ষণের পাশাপাশি ভয়াবহ শারীরিক অত্যাচার করা হয় তাঁর উপরে। সেই অত্যাচারের কাহিনি শুনে শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে চাপা দেওয়ার চেষ্টাও করেছিল অপরাধীরা। ঘটনার ১৩ দিন পরে ২৯ ডিসেম্বর মারা যায় মেয়েটি। দেশ জুড়ে শুরু হয় প্রবল জনআন্দোলন। ধরা পড়ে ছ’জন। বিচারচলাকালীনই পাঁচ জনের মধ্যে অন্যতম অভিযুক্ত রাম সিংহ ২০১৩ সালেই তিহাড় জেলে আত্মহত্যা করে। ধৃত ছ’জনের মধ্যে পাঁচ জনকে ফাঁসির সাজা শোনায় আদালত। ষষ্ঠ জন নাবালক হওয়ায় তিন বছর জেল খেটে বর্তমানে মুক্ত সে।
২০১৩ সালে ফাঁসির সাজা ঘোষণা হলেও, বারবার ক্ষমাপ্রার্থনার আর্জি জানিয়ে অন্তত তিন বার ফাঁসির দিন পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল সাজাপ্রাপ্তরা। কালও এক বার শেষ চেষ্টা করেছিলেন সাজাপ্রাপ্তদের আইনজীবী এ পি সিংহ। কিন্তু গভীর রাতে সুপ্রিম কোর্টে সেই আবেদন খারিজ হতেই আজ ভোরে ধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ফাঁসির সাজা কার্যকর করা হয় অক্ষয় ঠাকুর (৩১), পবন গুপ্ত (২৫), বিনয় শর্মা (২৬), মুকেশ সিংহ (৩২)-দের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে চার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের সাক্ষী থাকল তিহাড় জেল-সহ গোটা দেশ। আজ টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও জানিয়েছেন, ‘‘ন্যায়ের জয় হল।’’
ফাঁসির নির্ধারিত সময় ছিল সকাল সাড়ে ৫টা। কিন্তু ভোর ৩টে থেকেই ভিড় জমতে শুরু করে তিহাড় জেলের মূল প্রবেশপথের সামনে। ঘটনাচক্রে সে সময়েও সুপ্রিম কোর্টে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছিল মুকেশরা। ভোর পৌনে ৪টে নাগাদ ফাঁসি রদ করার সমস্ত আর্জি খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আর ভানুমতি। শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্ত আসতেই স্পষ্ট হয়ে যায় পূর্বনির্ধারিত সময়েই ফাঁসি হতে চলেছে চার জনের। ভোট ৪টে নাগাদ তিহাড়ে পৌঁছে যান জেলের ডিজি সন্দীপ গয়াল। শুরু হয়ে যায় শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
আরও পড়ুন: সেই ‘নাবালক’ কি পেল খবর!
যদিও জেল কর্তৃপক্ষ ফাঁসির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই। ফাঁসির আগের সন্ধ্যায় শেষ বারের জন্য পরিবারের লোকেদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয় সাজাপ্রাপ্তদের। চার জনের পরিবার চারটি পৃথক কক্ষে সাজাপ্রাপ্তদের সঙ্গে দেখা করে। সাজাপ্রাপ্তরা যাতে কিছু করে না-বসে, সে জন্য প্রতিটি ঘরে পাহারায় ছিলেন কারারক্ষীরা। সাক্ষাৎ-শেষে ফাঁসির আসামিদের জন্য বিশেষ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় পবন-মুকেশদের। সূত্রের খবর, গত জানুয়ারি মাস থেকে সলিটারি সেলে রাখা হচ্ছিল পবনদের। রাতে খাবার দাঁতে কাটেনি কেউই। জেল সূত্র জানিয়েছে, সারা রাত জেগেই কাটায় ওই চার জন।
আজ ভোর সওয়া ৩টে নাগাদ ডাকা হয় চার জনকে। বলা হয় স্নান সেরে নিতে। যদিও কেউই তা করেনি। সকালের চা-বিস্কুট খেতেও অস্বীকার করে তারা। জেলের আইন অনুযায়ী, ফাঁসির কিছু সময় আগে ব্ল্যাক ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে উপস্থিত হন তিহাড় জেলের এক পদস্থ কর্তা। তিনি প্রত্যেকের কাছে গিয়ে তাদের নাম ডেকে চিহ্নিত করেন। কেন ওই ব্যক্তিকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হল তা পড়ে শোনান। জানতে চাওয়া হয় তাদের কোনও শেষ ইচ্ছে বা তারা কোনও উইল করতে ইচ্ছুক কি না। জেল সূত্রের খবর, কেউই কোনও শেষ ইচ্ছে জানায়নি। উইলও করেনি।
সাড়ে পাঁচটার কিছু আগে ধৃতদের কাছে যান পবন জল্লাদ। উত্তরপ্রদেশের পবনের হাতেই এ বার ফাঁসির দায়িত্ব দিয়েছে তিহাড় কর্তৃপক্ষ। প্রত্যেকের হাত বাঁধা হয়। মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে আসা হয় বধ্যভূমিতে। এক-এক করে চার জনকে পরপর ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়। ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজতেই জেল কর্তৃপক্ষের সবুজ সঙ্কেতে লিভার টানেন পবন জল্লাদ। সরে যায় পায়ের পাটাতন।
তিহাড়ের বাইরে তখন সাংবাদিকদের সঙ্গেই ভিড় করেছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। দিল্লির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাত সকালে ছুটে আসা অধিকাংশের বক্তব্য, ‘‘এই শাস্তি আরও আগে হলে ভাল হত। দের আয়ে, লেকিন দুরুস্ত আয়ে। আশা করছি এতে মহিলাদের উপর অত্যচার কমবে। জেল সূত্রে পরে বলা হয়, নিয়ম মতো আধঘণ্টা পরে বেলা ছ’টা নাগাদ দু’জন চিকিৎসক এসে চার জনকে পরীক্ষা করে দেখে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আরও দু’ঘণ্টা অপেক্ষার শেষে, বেলা আটটা নাগাদ তিহাড় সংলগ্ন দীনদয়াল উপাধ্যায় হাসাপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয় চার জনের মৃতদেহ। পরে তাদের পরিবারের হােত দেহ তুলে দেওয়া হয়।
মেয়েকে হারানোর দীর্ঘ সাত বছর সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় পরে লড়াই শেষ হল নির্ভয়ার মা-বাবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy