সাষ্টাঙ্গে: রামমন্দিরের ভূমিপুজো অনুষ্ঠানের আগে শ্রীরামের বিগ্রহের সামনে প্রণাম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ডান দিকে, শ্রীরাম জন্মভূমি মন্দিরের ভূমিপুজোয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বুধবার অযোধ্যায়। পিটিআই
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার সংসদে প্রবেশের সময়ে হাঁটু গেড়ে, সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ‘ভাইরাল’ হয়েছিল ‘গণতন্ত্রের মন্দিরের’ সামনে ওই মাথা নোয়ানোর ছবি। বুধবার সেই মোদীই অযোধ্যার রাম জন্মভূমিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করলেন রামলালার মূর্তির সামনে।
সাষ্টাঙ্গ ওই এক বার হলেও, এ দিন প্রণাম অবশ্য বারবারই করেছেন মোদী। হনুমানগঢ়ীর মন্দিরে, রাম জন্মভূমি স্থলে, এমনকি অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে সামনে উপস্থিত সাধু-সন্তদেরও। যা দেখে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন গেরুয়াধারীরা। আবার অনেকে মনে করিয়েছেন, গত বছর দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংসদের সেন্ট্রাল হলে সংবিধানে মাথা ঠেকিয়েছিলেন মোদী। যে সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কথা বলে।
এ দিন রামমন্দিরের ভূমিপূজা ও শিলান্যাস সত্যিই পাঁচশো বছরের সঙ্কল্প পূর্তি, নাকি সরকারি হাতে হিন্দু রাষ্ট্রের ইট গাঁথা, তা নিয়ে দেশ জুড়ে চর্চা হয়েছে দিনভর। কিন্তু করোনা-কালেও গোটা দেশের নজর আটকে থাকা এই অনুষ্ঠানে প্রচারের আলো যে আগাগোড়া মোদীর উপরেই রইল, তা নিয়ে বিতর্কের সম্ভাবনা কম।
লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী অনুপস্থিত। রামমন্দির আন্দোলনের মূল কুশীলবদের মধ্যে দর্শকের আসনে শুধু উমা ভারতী। অন্য দলের নেতা তো ছার, সে ভাবে চোখে পড়লেন না বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, নেতারাও। সারাক্ষণ ক্যামেরা কার্যত তাক করা রইল মোদীর দিকেই।
হনুমানগঢ়ীর পূজা থেকে রামলালার আরতি— সর্বত্র ফ্রেম জুড়ে মোদী। ভূমিপূজার অনুষ্ঠানে তিনি যজমান। বক্তৃতার মঞ্চে তিনিই মধ্যমণি। বিরোধী দলের এক নেতার কথায়, “নিজে কেন্দ্রে থেকে নিখুঁত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মোদীর বরাবরের বিশেষত্ব। আর এ বার তো মন্দির তৈরির ‘কৃতিত্ব’ মোদীকে দিয়েই পরের লোকসভা ভোটে ঝাঁপাবে তাঁর দল!”
আরও পড়ুন: সেই নরম হিন্দুত্বই কংগ্রেসের খড়কুটো, রাহুল-প্রিয়ঙ্কার মুখে তাই রাম রাম
পোশাক নির্বাচন থেকে বক্তব্যের শব্দ চয়নে আগাগোড়া নিখুঁত থাকতে চেয়েছেন মোদীও। লোকসভা ভোটের আগে বারাণসীতে যেমন গেরুয়া পোশাকে দেখা গিয়েছিল, এ দিন তার ধারপাশ দিয়ে যাননি। পরেছেন সামান্য লম্বা ঝুলের সোনালি রংয়ের ফুলহাতা কুর্তা আর গরদরঙা ধুতি। সঙ্গে উত্তরীয়। দিল্লি থেকে বিমানে ওঠার সময়ে উত্তরীয়ের রং ছিল হাল্কা সাদাটে। কিন্তু অযোধ্যায় তা গেরুয়া-হলুদ। হনুমানগঢ়ীতে পুরোহিতের দেওয়া লালচে গামছাও ভূমিপূজায় বসার আগে উত্তরীয়ের উল্টো কাঁধ থেকে জড়িয়ে নিয়েছেন। অযোধ্যায় হেলিকপ্টার থেকে নামার পরে সেই যে মাস্কে মুখ ঢেকেছেন, মঞ্চ ত্যাগের সময় পর্যন্ত তা সঙ্গ ছাড়েনি তাঁর।
অযোধ্যার রক্ষক হিসেবে পরিচিত হনুমানের মন্দির ছুঁয়ে তবে রাম জন্মভূমি গিয়েছেন মোদী। সেখানে হনুমানের মূর্তিকে প্রণাম, আরতি, প্রদক্ষিণ করেছেন। বাদ পড়েনি বুক-পকেট থেকে বার করে প্রণামী দেওয়াও। পুরোহিতও মন্দির ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে পরিয়েছেন পাগড়ি, মুকুট আর গামছা।
টিভিতে ছেলের ভূমিপুজো দেখছেন হীরাবেন। গাঁধীনগরে।—ছবি পিটিআই।
মিনিট দশেকের মধ্যে মোদী রামলালার মূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতেই টিভির পর্দায় তা দেখে স্লোগান উঠেছে ‘জয় শ্রীরাম’। নবরত্ন পোশাকে সজ্জিত রামলালার পায়ে বেলপাতা, গলায় মালা দিয়ে আরতির সময়ে শঙ্খধ্বনি হয়েছে নাগাড়ে। বেরিয়ে এসে প্রণামী দিয়েছেন বাক্সে। রোপণ করেছেন পারিজাতের চারা। কথিত আছে, এই দুর্লভ ফুল স্বর্গের। পঞ্চপাণ্ডবের মাতা কুন্তীও নাকি পুজোর জন্য এই ফুলের আবদার করেছিলেন অর্জুনের কাছে।
ভূমিপূজার আসনে বসেও পুরোহিতের কথা অক্ষরে-অক্ষরে মেনেছেন ‘যজমান’ মোদী। মন্ত্রোচ্চারণ থেকে শুরু করে আঙুলে কুশের আংটি ধারণ— সব। যে চৌকো গর্তের কাছে আসনে বসলেন, হিন্দুদের অনেকের বিশ্বাস, ওইখানেই ৬ ফুট বাই ৩ ফুটের খাটিয়ায় রামচন্দ্রের জন্ম। বাবরি মসজিদের মূল গম্বুজের ঠিক নীচে নাকি তা ছিল। মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে ওইখানে সাদা তাঁবুর অস্থায়ী ছাউনিতে বিরাজ করতেন রামলালা। মন্দিরের নকশাও তৈরি হয়েছে এমন ভাবে, যাতে ঠিক ওইখানে গর্ভগৃহে স্থাপিত হয় রামলালার মূর্তি।
আরও পড়ুন: যেন শ্রাবণের সরযূ, রামভূমে ফিরে হিন্দুত্বে অর্গলহীন মোদী
পুরোহিত জানালেন, রামের শুভ জন্ম-মুহূর্ত অর্থাৎ অভিজিৎ মুহূর্ত ১২ টা ৪৪ মিনিট ৮ সেকেন্ডে। ঠিক ওই সময়ে যাতে মোদীর হাতে শিলান্যাস হয়, পূজা শুরু হল সেই অনুযায়ী। গণেশ-বাবা-মা-ইষ্টদেবতা-ভূমিদেবতা-বাস্তুদেবতাকে স্মরণ করে যে পুজো শুরু হল, তাতে বাদ গেল না কূর্মমাতা, পৃথিবী মাতা, অনন্ত শেষনাগ, বরাহদেবতা, মৎস্যদেবতা, দশাবতারের আরাধনাও। উঠল রামের কুলদেবতা কালিকা দেবী, মা দুর্গার নামাঙ্কিত কবচের প্রসঙ্গ। একে-একে পুজো করা হল গর্তে রাখা ন’টি ইটের। জানানো হল, সেখানে রাখা তাম্রপত্রে এ দিনের বিবরণ লিখে পাঠিয়েছেন কাঞ্চীর শঙ্করাচার্য। শেষ পর্যন্ত ঘড়ি মিলিয়ে মোদী যখন শিলান্যাস করলেন, তখন ফের ধ্বনি উঠল, ‘জয় শ্রীরাম’। মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন প্রধানমন্ত্রী। গর্ত থেকে তুলে সামান্য মাটি লেপে নিলেন কপালে।
পুজোয় মোদীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, রাজ্যপাল আনন্দীবেন পটেল, সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রয়াত কর্ণধার অশোক সিঙ্ঘলের পরিবারের সদস্য সলিল সিঙ্ঘল। সলিল ছাড়া বাকিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উঠে এলেন অনুষ্ঠানের মঞ্চে। যোগ দিলেন মন্দির নির্মাণের দায়িত্বে থাকা শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের প্রধান নৃত্যগোপাল দাস। ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই জানালেন, ৩৬টি ধর্মের ১৪০ জন সন্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত।
অবশ্য মন্দিরের কৃতিত্ব গেল মোদীর ঝুলিতেই। যোগীর দাবি, পাঁচশো বছরের সংঘর্ষ শেষেও কী ভাবে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সংবিধান মেনে সমাধানসূত্র বার করা যায়, তার নজির সৃষ্টি করেছে মোদী সরকার। মোহনের বক্তব্য, এই মন্দির আত্মনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী ভারত গড়ার সূচনা। অপেক্ষা রাম-রাজ্যেরও। তার জন্য দেশ যোগ্য হাতে রয়েছে বলে তাঁর দাবি। বিরোধীরা শুধু একান্তে বলছেন, “দেখে মনে হচ্ছে, রামকে ঘর যেন ফিরিয়ে দিলেন মোদী!” সোশ্যাল মিডিয়ায় আঁকা ছবি পোস্ট করেছেন এক বিজেপি নেতা। তাতেও মোদীই শিশু রামকে হাত ধরে মন্দিরে নিয়ে যাচ্ছেন!
প্রধানমন্ত্রী নিজে যদিও দাবি করছেন, মন্দির তৈরির দায়িত্ব এবং এই অনুষ্ঠান ট্রাস্টের। তিনি আমন্ত্রিত। বিজেপিও বলছে, সরকারি বরাদ্দ এতে থাকবে না এক নয়াও। কিন্তু এই দিনকে স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে তুলনার পরে অনেকেরই প্রশ্ন, মসজিদ নির্মাণের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেও তিনি এ ভাবে সাড়া দেবেন? মোদী মনে করিয়ে দিলেন, এখানে তাঁকে আসতেই হত। রামের কাজ না-করে তাঁর ছুটি কোথায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy