ঢাকায় দেওয়াল লিখন। —নিজস্ব চিত্র।
গত দেড় দশক ভারত শুধুমাত্র শেখ হাসিনার সঙ্গেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত করেছে, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে নয়। যদিও হাসিনার সর্বোচ্চ জনসমর্থন ৩৫ শতাংশের বেশি কখনও ছিল না। ঢাকা সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে এই মর্মে অভিযোগ জানালেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ সূত্র। এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় মুহাম্মদ ইউনূসের এক শীর্ষ প্রতিনিধির বক্তব্য, “দেশের বাকি যে ৬৫ শতাংশ মানুষ রয়েছেন, তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথাও নয়াদিল্লিকে ভাবতে হবে। সম্পর্কটা এত দিন দু’দেশের ছিল না। ছিল ভারত এবং আওয়ামী লীগের। এমন একটি ভাষ্য ভারতে তৈরি হয়েছে যেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছাড়া সবাই মৌলবাদী ইসলামপন্থী। অথচ বিএনপিতে বহু অসাম্প্রদায়িক নেতা রয়েছেন।”
অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চাই, হাসিনাকে সরানোর পরে তাঁর বাসভবনে যে চূড়ান্ত উগ্রতা, অভব্যতা দেখা গিয়েছে, তার কী যুক্তি? বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা গিয়েছে অরাজকতা। মূর্তি ভাঙা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটাই যেন বদলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। জবাবে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলমের বক্তব্য, “উগ্র ইসলামপন্থী হিসাবে কেউ মূর্তি ভাঙেননি। বরং শেখ হাসিনার উপরে মানুষের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ওই মূর্তিভাঙায়। গোটা দেশের ইতিহাস শুধুমাত্র এক জন ব্যক্তিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এত দিন, এটা অন্যায় নয়? বাংলাদেশের আনাচেকানাচে যত প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, সমস্ত এক জন ব্যক্তির নামে। প্রতিটা রাস্তায় দফতরে অনুষ্ঠানে এক জনেরই ছবি। সঙ্গে তাঁর কন্যা। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুজিববাদ দু'টো এক বিষয় নয়। যোগেন মণ্ডল, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তদের বাদ দিয়ে একটি পরিবারের গৌরবগাথা প্রচার করে গিয়েছেন হাসিনা, বাংলাদেশের ইতিহাসের নামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান তাজউদ্দীন আহমেদের কথা স্মরণ করা হয়েছে কি কখনও? না, হয়নি।”
ইউনূস সরকারের বক্তব্য, নয়াদিল্লির ধারণা বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী বোধহয় একই সংগঠন। কিন্তু এই দুইয়ের আদর্শগত অবস্থানের ফারাক রয়েছে। শফিকুলের কথায়, “আমরা কোনও চরমপন্থাকেই বরদাস্ত করব না। অধ্যাপক ইউনূসের কাছে ধর্মাচরণ একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, সমস্ত সম্প্রদায় যাতে এক হয়ে বাঁচে সে জন্য চেষ্টা করবে তাঁর সরকার।” প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখোমুখি বসে এই আস্থার সঙ্কট কাটাতে আগ্রহী ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের বক্তব্য, ঢাকার
পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন চলার সময়ে সেই চেষ্টা হয়েছিল। ভারতের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। নভেম্বরে তাইল্যাণ্ডে বিমস্টেক অধিবেশনে আবার চেষ্টা করা হবে। তাঁদের মতে, ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সমন্বয় আরও জোরালো হলে উভয় পক্ষেরই লাভ। কিন্তু তা করতে হবে পারস্পরিক সম্মান এবং সাম্য বজায় রেখেই।
বিদেশনীতির প্রশ্নে কেউই যে অচ্ছ্যুৎ নয়, সেই বার্তাও দিয়েছেন অন্তর্বতী সরকারের কর্তারা। বলা হয়েছে, পাকিস্তান-সহ সার্কের সমস্ত দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান ইউনূস। তাঁর মতে ঘুমিয়ে পড়া সার্ক-এর জেগে ওঠা, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলির যৌথ উন্নয়নের জন্যই প্রয়োজন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে নিশানা করে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব বলছেন, ভারতকে খুশি করার জন্য হাসিনা বারে বারে পাকিস্তান তাস খেলেছেন।
বিএনপি নেতা তথা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরুর কথায়, “ভারতকে এটা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন এসেছে। শুধু ভারত নয়, আমাদের, অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদেরও এই নতুন ভাষ্যকে বুঝতে হবে। এটা পনেরো বছরের সাধারণ মানুষের হতাশার বিস্ফোরণ। এখন মানুষের প্রত্যাশা আকাশ ছোঁয়া। রাজনৈতিক নেতাদের নড়েচড়ে বসে এগোতে হবে।” নয়াদিল্লির প্রতি বিএনপি-র বার্তা, অতীতে যা হয়েছে সেই ভার কাঁধে নিয়ে চললে সামনে এগোনো যাবে না। নয়াদিল্লির যদি বিএনপি-র বিরুদ্ধে ভারত-বিরোধী সংগঠনকে মদত দেওয়ার অভিযোগ থাকে, তা হলে বিএনপি-রও অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে চাকমা জনগোষ্ঠীকে ভারতের অস্ত্র সরবরাহের। খসরুর কথায়, “পারস্পরিক দোষারোপ চালিয়ে গেলে এগোনো যাবে না। সময় বদলেছে, সাধারণ মানুষের চাহিদা বদলেছে।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, গণঅভ্যুত্থান দমনের চেষ্টাকে ‘গণহত্যা’ তকমা দিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে বিচার করাটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের যে হেতু আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে বিচার হয়েছে, তাই তার সমান্তরাল একটি ভাষ্য তৈরি করতে সচেষ্ট বর্তমান সরকার, যারা বিএনপি-র তুলনায় জামায়াতের সঙ্গেই বেশি সংযোগ রেখে চলছে। ফলে একাত্তরের গণহত্যায় সেই সময়ের জামায়াত নেতারা যদি অপরাধী হন, তা হলে একই ভাবে ২০২৪-এর তথাকথিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতার’ যুদ্ধে আওয়ামী লীগের হাতেও 'গণহত্যার রক্ত' লেগে রয়েছে— এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধীদের হয়ে যিনি মামলা লড়েছিলেন সেই মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে এখন নিয়োগ করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ বিচারে প্রসিকিউটার হিসাবে। এই ইঙ্গিতও বার্তাবহ বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি এ কথাও জানাচ্ছেন স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা— নিষিদ্ধ হোক বা না হোক, গত দশ বছর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে গোপনে সংগঠন মজবুত করার কাজ করে গিয়েছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে।
আপাতত ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা সংস্কার কমিটিগুলির অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করার। মতে মিল না হলে বা নির্বাচনের বিলম্ব হলে রাস্তায় নামতে পারে রাজনৈতিক দলগুলি। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠন অথবা জামায়াতও হাত গুটিয়ে থাকবে না বলে অনুমান। নানা মত ও পথের ইসলামি দলগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ তৈরির সক্রিয়তাও দেখা যেতে পারে। বিবিধ সম্ভাবনার আগে আপাতত থমথমে ঢাকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy