দ্বারকায় নিজেদের ফ্ল্যাটে নির্ভয়ার মা আশা সিংহ। — নিজস্ব চিত্র
চার বছর তাঁরা দিল্লির বাইরে বেরোতে পারেননি, পাছে আদালতে হাজিরায় ছেদ পড়ে। ভগ্ন স্বাস্থ্য আর চুরমার হয়ে যাওয়া মন নিয়ে এখন প্রৌঢ় দম্পতির সাপ্তাহিক রুটিন হল, দ্বারকা সেক্টর-৯ থেকে প্রতি সোম আর শুক্রবার প্রায় পৌনে দু’ ঘণ্টার মেট্রো-যাত্রা করে সুপ্রিম কোর্টে এসে হাজিরা দেওয়া এবং আবার পৌনে দু’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে ফিরে যাওয়া।
তাঁদের একমাত্র মেয়ের ধর্ষণ ও মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোটা পৃথিবীতে তোলপাড় চলার পরে ভারতে যতই ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত নতুন আইন চালু হোক না কেন, সেই মেয়ের ধর্ষকদের ম্যারাথন বিচারপ্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। শেষ হয়নি বাবা-মায়ের দুর্বিষহ প্রতীক্ষা। কষ্টে কুঁকড়ে যাওয়া মুখে তাঁরা বলেন, ‘‘নির্ভয়ার মতো ঘটনাতেও চার ধর্ষককে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ানোর জন্য যদি আমাদের জুতোর সুখতলা এ ভাবে খুলে যায়, তা হলে দেশের বেশির ভাগ বিচারপ্রার্থীর কী অবস্থা অনুমান করুন।’’
দ্বারকার ৩ নম্বর পকেটের ছিমছাম এলাকাটা অপেক্ষাকৃত নতুন তৈরি হয়েছে। ফ্ল্যাটগুলিতে মূলত উচ্চমধ্যবিত্তদের বাস। অক্ষরধাম অ্যাপার্টমেন্টের তিন তলায় ১১৮ নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা সেখানে বেশ বেমানান। অতি সাধারণ তাঁদের প্রায়-আসবাবহীন ফ্ল্যাট। তিন কামরার সেই ফ্ল্যাটের ঘরে তক্তপোষে বসে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে নির্ভয়ার মা আশা সিংহ বলেন, ‘‘কার দায় পড়েছে এখনও নির্ভয়ার বিচার নিয়ে ভাবার? তা ছাড়া, দিল্লিতে ধর্ষণ এখন রোজের ব্যাপার। মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। একমাত্র যার বাড়িতে হয়, তার যায় আসে।’’ খানিক থমকান তিনি। তার পর বলেন, ‘‘আমরা তো চুপ করে বসতে পারব না। প্রতি মুহূর্তে মেয়ের দলা পাকানো শরীরটা চোখের সামনে ভাসে। যে ক’দিন বেঁচে ছিল এক চামচ জলও খেতে পারেনি। যারা ওর ওই অবস্থা করেছিল তাদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বেঁচে থাকাটাও যন্ত্রণার।’’
২৯ ডিসেম্বর মেয়ের মৃত্যুদিন। আরও একটা যুদ্ধ বাকি রয়েছে মায়ের— ‘নির্ভয়া ফান্ড’কে যথাযথ ভাবে কাজে লাগানোর জন্য সরকারকে বাধ্য করা। ২ হাজার কোটি টাকার এই তহবিল সরকার গড়েছে মেয়েদের নিরাপত্তা, ধর্ষিতাদের দ্রুত চিকিৎসা, আইনি সাহায্য এবং পুনর্বাসন দিতে। অথচ তিন-তিনটি বছর ধরে সেই টাকা পড়ে পচছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গাঁধীর যুক্তি, ‘‘এমন কোনও যোগ্য প্রকল্পের প্রস্তাব পাচ্ছি না যাতে ওই অর্থ ব্যয় করা যায়। ভুলভাল প্রকল্পে তো আর টাকা বরাদ্দ করা যায় না।’’ নির্ভয়ার মায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘তিন বছরেও যদি সরকার প্রকল্প বানাতে না পারে, তা হলে নীতি-নির্ধারকেরা আছেন কীসের জন্য? আমার প্রস্তাব ছিল, ওই টাকায় দেশজুড়ে ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি তৈরি হোক। যেখানে শুধু ধর্ষণের ঘটনার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা হবে।’’ সরকার শোনেনি? ‘‘নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলার কত চেষ্টা করেছি। উনি সময় দেননি।’’
গত চার বছর তাঁর বাড়িতে দীপাবলিতে প্রদীপ জ্বলেনি, হোলিতে এক চিমটে আবির হাতে তোলেননি পরিবারের কেউ। নিজের তক্তপোষের পাশের দেওয়াল-জোড়া একটি জ্বলন্ত শিখার ছবির দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রৌঢ়া চোয়াল শক্ত করে বলেন, ‘‘এটা কে জানেন? এই হল আমার মেয়ে। প্রতিজ্ঞা করেছি, যেদিন লড়াইয়ে জিতব, সেই দিন এই প্রদীপের জ্যোতির জায়গায় আমার মেয়ের আসল মুখের ছবি লাগাব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy