রবি বর্মার তুলিতে জটায়ু-বধ
সার কথাটা সত্তরের দশকেই বুঝেছিলেন গড়পারের লালমোহন গাঙ্গুলি। নিজের ‘ছদ্মনাম’ বেছে নিয়েছিলেন ‘জটায়ু’! এত দিনে প্রধানমন্ত্রী চাইছেন, কোটি কোটি ভারতবাসী মনেপ্রাণে জটায়ু হয়ে উঠুক! তবেই দেশ বাঁচবে!
লালমোহনের যুক্তি ছিল পরিষ্কার। ‘‘রাবণ রাজা জব সীতা মাইজিকো হরণ করকে লে জাতা থা, তব জটায়ু পক্ষী আকে উনকো বহুত পরেশান কিয়া! বড়িয়া পক্ষী জটায়ু!’’
প্রধানমন্ত্রীর যুক্তিও ততোধিক পরিষ্কার। ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবার প্রথম কে লড়েছেন? কোনও ফৌজি? কোনও নেতা? রামায়ণ সাক্ষী, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সবার প্রথম যিনি লড়েছিলেন, তিনি জটায়ু।’’ দশেরাতে লখনউ-এর রামলীলায় গিয়ে মোদী বলে এসেছেন এ কথা। সীতাকে রাবণের কবল থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন জটায়ু, সেটাই মোদীর বয়ানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই।
রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডে একান্নতম সর্গে রাবণের সঙ্গে জটায়ুর যুদ্ধের কাহিনি আছে। বাল্মীকির বর্ণনায়, সেই তুমুল যুদ্ধ দেখে মনে হচ্ছিল পাখাওয়ালা দুই পর্বত লড়াই করছে। রাবণ প্রথমে জটায়ুকে অনেকগুলি বাণ ছোড়েন। জটায়ু প্রত্যাঘাত করে রাবণের ধনু, রথ ভাঙলেন। তাঁর সারথির মাথা ছিন্ন করলেন। রথের অশ্বগুলি নিহত হল। রাবণ বৈদেহীকে কোলে নিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। জটায়ু তখন ক্লান্ত। সেই সুযোগে রাবণ শূন্যমার্গে ওঠার চেষ্টা করতেই জটায়ু ফের রাবণকে আক্রমণ করেন। রাবণের সর্বাঙ্গ বিদীর্ণ করেন। রাবণের বাঁ পাশের দশটি হাত ছিঁড়ে নেন। এর উত্তরে রাবণ খড়্গ দিয়ে জটায়ুর দুই পাখা, পা ও পার্শ্ব ছেদন করেন। তখন জটায়ু মাটিতে পড়ে যান। মহাভারতের বনপর্বেও জটায়ুর এই লড়াইয়ের কথা বলেছেন ঋষি মার্কণ্ডেয়।
মণিহারা ফণীর মতো উদভ্রান্ত রাম যখন সীতাকে খুঁজতে বেরোলেন, তখন মৃত্যুপথযাত্রী জটায়ুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। মৃত্যুর আগে জটায়ু তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খবর রামকে দিলেন। এক, সীতাকে কে হরণ করেছে, সে কোন দিকে গিয়েছে। দুই, রাবণের প্রকৃত পরিচয় কী। এবং তিন, জটায়ু আশ্বাস দিয়ে বললেন, সীতাকে হরণ করা হয়েছে বিন্দ লগ্নে। ওই মুহূর্তে অপহৃত ধন পুনঃপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। এর পরেই জটায়ুর মৃত্যু। রাম তাঁর উদ্দেশে হরিণ মাংসের পিণ্ড দেন।
এত দিন পরে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘‘আমরা রাম না হতে পারি, জটায়ু তো হতে পারি! ১২৫ কোটি দেশবাসী একজোট হলে কম কী?’’ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেই শুনে বললেন, ‘‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জটায়ু প্রথম লড়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু জটায়ু তো হেরে গিয়েছিলেন! আমরা কি হেরো উপমা ব্যবহার করব?’’
অথচ খোদ প্রধানমন্ত্রীর বাণী! বিজেপি শিবির তো সেটা ফেলে দিতে পারে না! জটায়ু নিয়ে তাই রাতারাতি গবেষণার ধুম পড়ে গিয়েছে দলের অন্দরে। এতটাই যে, সঙ্কটমোচনের আসন টলোমলো হওয়ার উপক্রম!
এত দিন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের কর্মীরা হনুমানকে দেখে প্রাণিত হয়েছেন। ়সরসঙ্ঘচালক বলিরাম হেগড়েওয়াড় আমৃত্যু তাঁর প্রার্থনা শেষ করতেন, ‘জয় বজরংবলী’ বলে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ১৯৮৪ সালে তৈরি করে বজরং দল। দক্ষিণে রাম সেতু নিয়ে যে আইনি লড়াই বিজেপি চালিয়ে গিয়েছে, তার পিছনেও হনুভক্তি। বানরসেনাই এই সেতু বানিয়েছিল বলে বিশ্বাস বহু মানুষের।
সন্ত্রাস নিয়ে সরকারি বয়ানেও অনুপস্থিত ছিলেন না পবনপুত্র। হনুমানই ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে’র প্রণেতা বলে বাজার গরম করেছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জটায়ুকে নতুন আইকন বানিয়ে দিয়েছেন। বিজেপির মুখপাত্র অনিল বালুনি স্বীকার করছেন, জ্ঞানের ভাণ্ডার বাড়ন্ত। ‘‘আমরা এখনও জটায়ুর পুজো-আচ্চা নিয়ে খুব বেশি কিছু জানি না।’’ রামেশ্বরমে জটায়ু মন্দির আছে বটে। কথিত আছে, ওখানে রাম সমাহিত করেন জটায়ুকে। কেরলের চড়ায়ামঙ্গলম-এ জটায়ুর পতন হয়েছিল বলে জনশ্রুতি। সেখানে জটায়ু পার্ক হচ্ছে। এ সব এখনও বিজেপির প্রচারে আসেনি সে ভাবে!
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধানমন্ত্রী আসলে মানুষকে জঙ্গি গতিবিধির বিরুদ্ধে চোখ-কান খোলা রাখতে বলেছেন। সেটাই ‘জটায়ু মডেল’। সিবিআই-এর প্রাক্তন নির্দেশক ডি আর কার্তিকেয়ন মানছেন, ‘‘সাধারণ মানুষ বহু ক্ষেত্রে চমকপ্রদ তথ্যের জোগান দিয়েছেন।’’
লালমোহনবাবুও সাধারণ মানুষ। বড়িয়া পক্ষীকে চিনতে তাঁর ভুল হয়নি।
(তথ্য সহায়তা: অলখ মুখোপাধ্যায়)
জটায়ু চরিত
বাল্মীকির বর্ণনায়, ‘মহাকায়ং গৃধ্রং ভীমপরাক্রমম্’। অরুণ ও শ্যেনীর বংশধর। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম সম্পাতি।
রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ
• অরণ্যকাণ্ডে সীতাহরণ। বৃক্ষমধ্যস্থ পর্বতশিখরতুল্য তীক্ষ্ণচঞ্চু জটায়ু তখন নিদ্রিত। সীতার বিলাপে তাঁর ঘুম ভাঙে।
• জটায়ু রাবণের ধনু, রথ ভাঙলেন। সারথির মাথা ছিন্ন করলেন। রাবণের বাঁ পাশের দশটি হাত ছিঁড়ে নিলেন।
• রাবণ খড়্গ দিয়ে জটায়ুর দুই পাখা, পা ও পার্শ্ব ছেদন করেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy