রেল নিয়ে তাঁর স্বপ্ন অনেক। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণে রেল মন্ত্রকের তরফে যথেষ্ট তৎপরতা চোখে পড়ছে না বলেই মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় মন্ত্রিসভার প্রথম রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়াকে সরিয়ে দিয়েছিলেন রদবদলের প্রথম সুযোগেই। সেই পদে এনেছিলেন নিজের আস্থাভাজন সুরেশ প্রভুকে। কিন্তু এ বার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কড়া চিঠি পেলেন প্রভুও। প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নৃপেন্দ্র মিশ্রের পাঠানো ওই চিঠির সার বক্তব্য একটাই— ‘‘রেলের কাজের গতি মোটেই আশাপ্রদ নয়।’’
ভারতের মাটিতে বুলেট ট্রেনের দৌড় থেকে বিদেশি বিনিয়োগ টেনে আর্থিক বৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া— রেল নিয়ে এমন নানা পরিকল্পনার কথা নিয়মিত শুনিয়েছেন মোদী। কিন্তু ঘটনা হল, মন্ত্রকের দায়িত্ব নেওয়া ইস্তক প্রভুও নানা সমস্যায় জেরবার। একে তো চলতি বাজেটের পর যাত্রী-ভাড়া থেকে আয় কমেছে, পণ্য পরিবহণ বাড়লেও তা খুব একটা উল্লেখজনক কিছু নয়। বুলেট ট্রেন তো দূর, সেমি হাই-স্পিড ট্রেনও এখনও ছোটানো যায়নি। সময়ে খরচ করা যায়নি বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ। এ দিকে দুর্ঘটনাও লেগে রয়েছে। এই নেতিবাচক ছবি বদলানোর পরামর্শই মূলত দেওয়া হয়েছে গত ৭ সেপ্টেম্বর পাঠানো ওই চিঠিতে।
চিঠিতে একটি বার্তা পরিষ্কার দেওয়া হয়েছে প্রভুকে— অবিলম্বে রেলের প্রকল্পে গতি আনতে হবে। বিশেষত সেই সব প্রকল্পে, যেগুলি ভবিষ্যৎমুখী এবং চোখে পড়ার মতো (এবং অবশ্যই যেগুলিকে মোদী গুরুত্ব দিচ্ছেন)। যেমন, হাই-স্পিড ও সেমি হাই-স্পিড ট্রেন চালানো, প্রায় ৪০০ স্টেশনের উন্নয়ন, পরিচ্ছন্নতা। এর মধ্যে প্রথম দু’টি ক্ষেত্রের অগ্রগতি নিয়ে যথেষ্ট হতাশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর। মুম্বই-আমদাবাদ হাই-স্পিড করিডর নিয়ে ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু ওই প্রকল্পের রূপায়ণ নিয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি রেল মন্ত্রক। এক কর্তার কথায়, ‘‘রেলের কাছে ওই প্রকল্পে বিনিয়োগ করার মতো টাকা নেই। ফলে সেটি কী ভাবে রূপায়িত হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কেন্দ্রকে। বিষয়টি খুব শীঘ্রই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আনা হবে।’’ গত বছর দিল্লি-আগ্রা সেমি হাই-স্পিড ট্রেনের সফল ট্রায়াল রান হয়েছিল। কিন্তু গোটা রেলপথটি লোহার বেড়া দিয়ে না ঘেরা পর্যন্ত ১৮০ কিলোমিটার গতিতে ওই ট্র্যাকে ট্রেন চালানোয় আপত্তি জানিয়ে রেখেছে কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি।
ইতিমধ্যে লাফ দিয়ে বেড়েছে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা। গত ছ’মাসে ৯টি রেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ৮৫ জন। আহত হয়েছেন সাড়ে চারশোর কাছাকাছি যাত্রী। একই রেলসেতুর উপর পরপর দু’টি দুর্ঘটনাও হয়েছে অগস্টে। স্বাভাবিক ভাবেই এতে অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। অবিলম্বে যাত্রী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ জোর দিতে বলা হয়েছে রেল মন্ত্রককে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুর্ঘটনা রুখতে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্র ব্যবহারের।
তবে অনেকেই বলছেন, রেলের কাছে এখন মূল সমস্যা হল, গত ছ’মাসে যাত্রী ভাড়া থেকে আয় অনেকটাই কমে যাওয়া। এর জন্য বিমানের সস্তার টিকিট যেমন অনেকাংশে দায়ী, তেমনই গত কয়েক বছরে সড়ক পথে যাতায়াতও অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যগুলির ক্ষেত্রে আয় হারাচ্ছে ভারতীয় রেল। যদিও মন্ত্রকের একটি সূত্রের দাবি, বছরের মাঝামাঝি সময়টায় বরাবরই একটু মন্দা যায়। পুজো-দীপাবলির মরসুমে সেই ফারাক অনেকটা কমে আসে। মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, এই ছ’মাসের আয়েই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়। তবে বিক্ষোভ বা সময়ে ট্রেন না চলার মতো ঘটনার জেরে শহরতলির ট্রেনে যে যাত্রী কমেছে, তা মানছেন রেলের কর্তারা। খোঁজা হচ্ছে সমাধান।
যাত্রী-আয়ের মতো পণ্য পরিবহণ থেকেও আশানুরূপ আয় আসছে না রেলের ঘরে। পূর্ব-পশ্চিম পণ্য পরিবহণ করিডরের কাজ আশানুরূপ গতিতে এগোচ্ছে না বলে মনে করছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর। তবে রেল মন্ত্রকের কেউ কেউ বলছেন, মোদীর হাত ধরে দেশীয় অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে— এমন আশাতেই বছরে এক লক্ষ টনের বেশি পণ্য পরিবহণের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিল রেল। কিন্তু অর্থনীতি সে ভাবে গতি না পাওয়ায় পণ্য পরিবহণের হার উল্লেখযোগ্য রকম বাড়েনি। অথচ রেলের আয় মূলত আসে পণ্য পরিবহণ থেকেই। ফলে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া না গেলে রেল বড় মাপের ক্ষতির মুখ দেখবে। বাড়বে অপারেটিং রেশিও। যা মোটেই কাম্য নয় মোদীর কাছে।
শোনা যায়, সদানন্দ গৌড়ার কাজে মোদী এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে, তৎকালীন রেলমন্ত্রীকে এড়িয়েই প্রকল্প নিয়ে কথা বলতেন রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। সেই পরিস্থিতি এখন পাল্টালেও রেলের কাজকর্ম দেখার জন্য গুজরাত ক্যাডারের এক আমলাকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন তিনি। মোদীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি অবশ্য চিঠিতে লিখেছেন, সুরেশ প্রভুর নেতৃত্বে রেল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। কিন্তু ফাঁকতালে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন, প্রভুতে এতই আস্থা থাকলে অসন্তোষের চিঠি সংবাদমাধ্যমের হাতে পৌঁছে গেল কী করে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy