লক্ষ্মীদের সঙ্গে তিন ভাই। অন্ধ্রের বেঙ্কটপুরমে। নিজস্ব চিত্র
মাথাটা জোরে-জোরে নাড়ছেন রামাইয়া। না, না এটা হতে পারে না। বারবার মাথা নাড়ছেন আর একই কথা বলছেন। কেউ কিছু বলতে গেলে বলছেন, ওরা সেই বাবা-ঠাকুরদার সময় থেকে আছে। এটা হতে পারে না!
সামনে অপরাধীর মতো মুখ করে বসা রামানামূর্তি, বেণুগোপাল। রামাইয়ার দুই ভাই। রামানামূর্তিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন আগে। তা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই পরিবারের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। সেই প্রস্তাবের ফয়সালা করতেই এ দিনের বৈঠক। পাশাপাশি আরও কয়েক জন চেনা-পরিচিতও রয়েছেন। বেঙ্কটপুরম গ্রামের বাড়ির চৌহদ্দির গাছের তলায় সকলে গোল করে বসে। অলস সকালটা যে মুহূর্তে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়বে, ঠিক সেই মুহূর্তেই রামানামূর্তি বলেছিলেন, ‘‘রূপা, লক্ষ্মীদের তা হলে বিক্রি করে দিই এ বার! ওদের এ ভাবে রেখে লাভ কী!’’
রামানামূর্তি জানতেন, কথাটা বলামাত্রই প্রতিবাদ আসবে, হলও তাই। কিন্তু উচিত কথা তো কাউকে-না-কাউকে বলতেই হবে! খরার দাপট ক্রমশ বাড়ছে। রামানামূর্তিদের এখনও জোর আছে, এখনও সম্বল আছে, তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু রূপা-লক্ষ্মী-সীতাদের মতো অবোলা পোষ্যদের কী দোষ! খাটালভর্তি গরু, মোষের দল। আগে তিনবেলা খড় খেত ওরা, এখন সেটা কখনও দু’বেলা, কখনও একবেলা। বেণুগোপাল বলছিলেন, ‘‘ধনী কৃষকদের এই পরিস্থিতিতে খুব একটা যায় আসে না। দরিদ্র কৃষকেরাও অন্যত্র যে কোনও কাজের খোঁজে চলে যেতে পারেন। কিন্তু আমরা, যাঁরা মধ্যবিত্ত কৃষক, তাঁরা ঘর-গেরস্থালি ফেলে কোথায় যাব! পরিবারগুলোই ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে এই চিন্তায়-চিন্তায়!’’
বাড়ির চত্বরে রাখা ট্রাক্টর। শান্ত, নিঝুম, চুপচাপ। এমন অসম্ভব চুপচাপ সময়ে রোজ ‘বাতাবরণ কেন্দ্র’ বা আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস শোনেন বেণুগোপাল। সেখান থেকেই জানতে পেরেছেন, কম বৃষ্টিপাতের নিরিখে অন্ধ্রপ্রদেশের সব থেকে বড় জেলা এই অনন্তপুর রাজস্থানের জয়সলমেরের পরেই, দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে। ২০১৮-র জুন থেকে ২০১৯-র জানুয়ারি যা বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল, তার থেকে ৪৭ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। বেণুগোপাল বলছেন, ‘‘তিন বছর হয়ে গেল বৃষ্টি নেই এ এলাকায়। বীজ বোনা যায়নি।’’
তবু বছরের এই সময়টা চাষিরা নিয়মমতো ট্রাক্টর চালিয়ে মাঠকে প্রস্তুত করে তোলেন চাষের জন্য। ঘরভর্তি করে রাখা আছে ফসলের বীজ। তার পর মাঠের পর মাঠ জুড়ে শুধু বৃষ্টির অপেক্ষা। কিন্তু বরুণদেব এখানে তাকান না বহুদিন হয়ে গেল। শুধু খরখরে রোদ আর ফাটল ধরা, রুক্ষ জমি! রামাইয়া বলছিলেন, ‘‘কখনও-সখনও মেঘ দেখা যায় কিন্তু বৃষ্টি নেই একফোঁটা।’’ তখন শুধু আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস শোনাই একমাত্র কাজ রামাইয়া, বেণুগোপালদের। আর যাঁদের সেটুকু সম্বল পর্যন্ত নেই, তাঁরা অন্যত্র কাজ খুঁজতে যান।
খরা শুধু তো বেঙ্কটপুরমের অর্থনীতি, জীবন পাল্টাচ্ছে না, পাল্টে দিচ্ছে পরিবারের কাঠামো। রামাইয়া যতই লক্ষ্মী, সীতাকে নিয়ে বর্ধিত পরিবারকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করুন, যৌথ পরিবার ভেঙে দিয়ে ছোট-ছোট পরিবার তৈরি করে তুলছে খরা, বলছেন আরেক কৃষক ভাস্কর রেড্ডি। তাঁর কথায়, ‘‘গত কয়েক বছরে এলাকার বড় পরিবারগুলো ভেঙে ছোট-ছোট পরিবার হয়ে গিয়েছে। কারণ, বড় পরিবার মানেই পেটের সংখ্যা বেশি। কিন্তু অত ফসল কোথায়! ফসলই তো হচ্ছে না!’’ আর এক চাষি গফর বলছেন, ‘‘আগে নিজেকে বাঁচাও। সকলে এখন এটাই ভাবছেন।’’
রুখাসুখা জমিতে ফসল হয় না। তাই ধারদেনা করে দু’টো গরু কিনেছেন বছর আটষট্টির কৃষক পেদাইয়া। বলছেন, ‘‘ফসল নেই মাঠে। কী করে চলবে। গরু কিনলাম। যদি দুধ বেচে সংসার চালাতে পারি।’’
খরার থাবা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়তে-বাড়তে তা ছুঁয়ে ফেলছে জমির পরে জমি, খেতের পরে খেত, ক্রমশ সে আকাশমুখী। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কাঠফাটা জমি যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে! আর সেই থাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য রামানামূর্তি আজন্ম সঙ্গী পোষ্যদের বিক্রি করে দিতে চাইছেন, আবার বৃদ্ধ পেদাইয়া আঁকড়ে ধরতে চাইছেন পোষ্যকেই। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতের মাঝখানে পড়ে পদ্মপাতার জলের মতো দোদুল্যমান বেঙ্কটপুরম শুধু চোখ রাখছে আকাশে।
বৃষ্টি হবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy