যন্তরমন্তরে পড়ুয়াদের বিক্ষোভ। ছবি: পিটিআই.
ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ জেএনইউয়ের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে উঠে এসেছে ‘জন-পথে’। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার প্রতিবাদী পড়ুয়াদের পিঠে প্রথমে লাঠি পড়লেও, নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে এখন গর্জে উঠেছেন দেশের মানুষের বড় অংশ। সরকারের মতে, এখনও এই বিক্ষোভ সীমিত কিছু নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস আর সমাজের অতি সামান্য অংশের মধ্যে। কিন্তু প্রতিবাদীদের আশা, অন্তত শুরু হয়েছে ‘সাহস করে মুখ খোলা’। তবে আক্ষরিক অর্থে জন-আন্দোলনের চেহারা পেতে বহু পথ হাঁটা বাকি বলে মানছেন তাঁরাও।
গত দেড় মাস ধরে ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-র সভাপতি এন সাই বালাজি, জেএনইউয়ের ছাত্র সংগঠন জেএনইউএসইউয়ের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষেরা বার বার বলেছেন, ফি বৃদ্ধি পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবিতে তাঁদের এই আন্দোলন শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে আটকে থাকবে না। বরং সরকারের যে কোনও ভ্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে তা পথে নামার সাহস জোগাবে সাধারণ মানুষকে। পুলিশের লাঠিতে আহত জামিয়ার পড়ুয়া চন্দন কুমারও মনে করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস প্রায় যে কোনও দেশে প্রথম দেখান পড়ুয়ারাই। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠনও এই যুক্তি সমর্থন করে শান্তিপুর্ণ বিরোধিতায় পাশে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদের। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, প্রতিবাদের আঁচ ছুঁয়েছে আইআইটি, আইআইএম, এআইএমএসের মতো কুলীন প্রতিষ্ঠানকেও।
কিন্তু তার পরেও সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি, দেশের তিনশোরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে হিংস্র প্রতিবাদ হয়েছে মেরেকেটে চারটিতে। তাকেই বাড়িয়ে প্রচার করছে সংবাদমাধ্যম। বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্রের আবার দাবি, বিষয়টি ছাত্র আন্দোলনও নয়। পড়ুয়াদের নিছক বোড়ে হিসেবে ব্যবহার
করছেন বিরোধীরা।
কিন্তু কানহাইয়া কুমারের পাল্টা যুক্তি, ‘‘প্রতিবাদ হিংস্র কিংবা দেশব্যাপী কি না, তা বড় কথা নয়। কিন্তু ভয়ের চাদর সরিয়ে এই যে মানুষ রাস্তায় নামছেন সাহস করে, তা ওই ছাত্র আন্দোলনের বড় প্রাপ্তি।’’ তাঁর দাবি, গণ আন্দোলন এক দিনে কিংবা এক বারে তৈরি হয় না। বরং একটি আর একটির জন্য ভিত তৈরি করে। তার পরে তা ছড়িয়ে যায় দেশের সর্বত্র। জেএনইউ বা জামিয়া সাহস করে পা না-বাড়ালে, প্রতিবাদ এমন সর্বাত্মক চেহারা নিত কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি।
প্রতিবাদ এখনও কতটা সর্বাত্মক, সে বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত নন সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদব। তাঁর মতে, ‘‘অসমিয়ারা এনআরসি-র বিরোধিতায় নেমেছেন মূলত বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালিদের নাগরিকত্ব পাওয়া রুখতে। মুসলিমদের তাড়া করছে নাগরিকত্ব খোয়ানোর ভয়। পড়ুয়া এবং সাধারণ মানুষের একটা অংশ প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন স্রেফ সংবিধান বাঁচানোর জন্য। যতক্ষণ এই তৃতীয় ধরনের প্রতিবাদীর সংখ্যা না-বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ দিন তাকে জিইয়ে রাখার মতো সংগঠনের ভিত্তি, তত দিন এর গণ-আন্দোলন হয়ে ওঠা শক্ত।’’ নিজের কিছু খোয়ানোর না-থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদে পা মেলানোর লোক বাড়লে, তবেই সেই আন্দোলন দীর্ঘ মেয়াদে দানা বাঁধে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ক্যাম্পাস থেকে মুখ তোলা এই আন্দোলন যে ভয়ের বাতাবরণের মধ্যেও প্রতিবাদের প্রথম সুরটুকু অন্তত বেঁধে দিতে পেরেছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত অনেকে। তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় সম্প্রতি বলছিলেন, ‘‘মোদী-শাহ জুটিকে এ বার অন্তত ছোঁয়া যাচ্ছে। এ বার ধাক্কা দেওয়ার পালা।’’ কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী শুক্রবারই ভিডিও-বার্তায় বলেছেন, ‘‘মোদী সরকারের বিভাজনকারী ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দানা বেঁধেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।’’ সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি জেএনইউয়ের ছাত্র-নেতা থাকাকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গাঁধীকে ঢুকতে না-দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। লেখিকা অরুন্ধতী রায়ও বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়েও ইংরেজরা ভেবেছিল যে, পথে নেমেছেন খুব কম মানুষই।
অনেকে বলছেন, এমন ‘নেতাহীন’ আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয় না অনেক সময়েই। কেউ বলছেন, হিংসা বাড়তে থাকলে, ধস নামতে পারে জনসমর্থনের ভিতে। অনেকের আশঙ্কা, একে স্রেফ সংঘ্যালঘুর আন্দোলন হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে মোদী সরকার। উল্টো দিকে আন্দোলনে শামিল অধ্যাপকদের অনেকে বলছেন, ডিরোজিও-র ছাত্রদের হাত ধরে বাংলায় রেনেসাঁসের সূত্রপাত, তামিলনাড়ুতে ছাত্রদের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে হালের জেএনইউ, জামিয়ার লড়াই— সব ক্ষেত্রেই লড়াইয়ের প্রথম স্ফূলিঙ্গ ছিল পড়ুয়াদেরই। সেই আশা এ বারও করছেন তাঁরা। তবে তার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখার মতো নেতা, সংগঠন এবং শত প্ররোচনাতেও হিংসা থেকে দূরে থাকার ক্ষমতা জরুরি বলে তাঁদের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy