Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Coromandel Express accident

কার ত্রুটিতে সিগন্যাল সবুজ দেখল করমণ্ডল? উঠে আসছে একের পর এক চমকে দেওয়ার মতো তথ্য

প্রশ্ন উঠছে, রেলের ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং ব্যবস্থা সত্যিই গলদ-প্রতিরোধী বা ‘ফেল-সেফ’ হলে সে দিন সিগন্যালিংব্যবস্থায় পয়েন্টের এই গলদ ধরা পড়েনি কেন?

Coromandel Express Accident

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা। —ফাইল চিত্র।

ফিরোজ ইসলাম 
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৩ ০৭:১৬
Share: Save:

করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তদন্তে উঠে আসছে একের পর এক চমকে দেওয়া তথ্য।

গত ২ জুন ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশন লাগোয়া রেল গেটে দুর্ঘটনার অন্তত দু’ঘণ্টা আগে থেকে সিগন্যালিং ব্যবস্থার মেরামতি চলছিল। তার পরেও আপ মেন লাইনের ডিসট্যান্ট সিগন্যাল সবুজ দেখতে পেয়েছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের চালক। সন্ধ্যা ৬টা ৫১ মিনিট নাগাদ খান্তাপাড়া এবং তার পরে ইব স্টেশন পার হওয়ার পরে গতি কমানোর কোনও বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছয়নি। স্টেশনে ঢোকার ঠিক আগে হোম সিগন্যালও সবুজ পেয়েছিলেন তিনি। ওই সময়ে লুপ লাইনের দিকে পয়েন্ট সেট হয়ে থাকলে নিয়ম অনুযায়ী কতকটা বাঁকানো হাতের মতো দেখতে ‘রুট ইন্ডিকেশন সিগন্যাল’ হলুদ থাকা উচিত ছিল বলে জানাচ্ছেন রেলের আধিকারিকদের একাংশ। সে ক্ষেত্রে কিছুটা দূর থেকেই গতিবেগ কমিয়ে ঘণ্টায় ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটারে নেমে আসতে হত করমণ্ডলকে। তার বদলে ঘণ্টায় ১২৮ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেনটি মেন লাইন ছেড়ে লুপ লাইনে ঢুকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা লৌহ আকরিক ভর্তি মালগাড়িতে ধাক্কা মারে।

প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত, করমণ্ডলের লাইনের পয়েন্ট ঘোরানো ছিল লুপের দিকে। প্রশ্ন উঠছে, রেলের ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং ব্যবস্থা সত্যিই গলদ-প্রতিরোধী বা ‘ফেল-সেফ’ হলে সে দিন সিগন্যালিংব্যবস্থায় পয়েন্টের এই গলদ ধরা পড়েনি কেন? তবে কি যাঁরা সে দিন কাজ করছিলেন (যে কাজের জন্য প্যানেল ইন্টারলকিং ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছিল), তাঁদের হাতেই কোনও ভাবে সিগন্যালিং ব্যবস্থা প্রভাবিত হয়েছিল? সাধারণ ভাবে রুট সেট করার এবং সিগন্যাল হওয়ার জন্য প্যানেল ইন্টারলকিং বোর্ডে দু’টি সুইচ থাকে। সেই দু’টিকে একসঙ্গে সক্রিয় করাটাই নিয়ম। ট্রেনের পথ করে দেওয়ার দায়িত্ব স্টেশন মাস্টারের। তিনি কি শেষ পর্যন্ত সব কিছু পরীক্ষা করেছিলেন?

রেল সূত্রের খবর, ঘটনার দিন বাহানাগা বাজার স্টেশনের আগে একটি লেভেল ক্রসিং গেটের বুম (যে অংশটি নীচে নেমে আসে) পাল্টে আধুনিক ইলেকট্রনিক বুম ব্যারিয়ার বসানো হচ্ছিল। বিকেল ৪টে ৩৫ মিনিট নাগাদ ওই কাজ করার জন্য স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ফর্মের মাধ্যমে সময় নেন ওই শাখার সেকশন সিগন্যাল ইনস্পেক্টর। প্রায় দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কাজ চলে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিট নাগাদ মেন লাইন ফাঁকা রাখার জন্য মালগাড়িটিকে লুপ লাইনে সরানো হয়। প্যানেল ইন্টারলকিং বিচ্ছিন্ন থাকায় ওই সময়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পেপার সিগন্যাল দিয়ে ধীর গতিতে ট্রেন চালানো হয় বলে খবর।

সন্ধ্যা ৬টা ৫০ নাগাদ নতুন বুম ব্যারিয়ারটিকে প্যানেল ইন্টারলকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করেন সেকশন সিগন্যাল ইনস্পেক্টর। স্টেশন মাস্টারকে জানান, তাঁর কাজ শেষ। ইন্টারলকিং ব্যবস্থায় লেভেল ক্রসিংয়ের গেট ঠিকমতো বন্ধ না হলে ট্রেন সিগন্যালই পায় না। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, সে দিন সিগন্যালিংয়ের কাজ হওয়ার পরে ইন্টারলকিং ব্যবস্থা আবার ঠিকমতো কাজ করছে কি না, স্টেশন মাস্টার বা সিগন্যালিং বিভাগের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক কি তা পরখ করে নিয়েছিলেন?

প্যানেল ইন্টারলকিং ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সুইচ-রেল (যা অবস্থান পরিবর্তন করে ট্রেনকে নির্দিষ্ট লাইনে যেতে সাহায্য করে) ছাড়াও অ্যাক্সেল কাউন্টার এবং রিলে থাকে। অ্যাক্সেল কাউন্টার লাইনে ট্রেনের উপস্থিতি জানান দেয়। পয়েন্টের অবস্থান এবং দিক নির্দেশ করে রিলের সঙ্গে বসানো সেন্সর। সেই সেন্সর কী ভাবে পয়েন্টের অবস্থান পড়তে ভুল করল? তবে কি লেভেল ক্রসিংয়ের নতুন বুম ব্যারিয়ারকে ইন্টারলকিং ব্যবস্থায় জোড়ার সময়ে কোনও ভাবে পয়েন্টের সঙ্গে যুক্ত সেন্সরের তারে কারও হাত পড়ে গিয়েছিল? রেলের এই প্রযুক্তির নিয়ম অনুযায়ী, সেটির কোনও জায়গায় ত্রুটি থাকলে পুরো বৈদ্যুতিন ব্যবস্থাটাই লাল রঙের আলোয় জ্বলে উঠে ‘বিপদ’ চিহ্নিত করবে। তা-ও যে হয়নি, কার্যত স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রে আবার প্রশ্ন, ব্যবস্থাটির ভিতরেই কি কোনও ত্রুটি ছিল? গত ফেব্রুয়ারিতে একই রকম একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পশ্চিম রেলের প্রিন্সিপ্যাল চিফ অপারেশন ম্যানেজারের দেওয়া রিপোর্টের সূত্রে ‘সিস্টেম’-এর ত্রুটি নিয়ে জল্পনা আরও বেড়েছে। করমণ্ডলের দুর্ঘটনার পরে ওই শাখায় রেলের সিনিয়র সেকশন ম্যানেজার নিজের রিপোর্টে দাবি করেছেন, পয়েন্ট বদল হয়েছে দুর্ঘটনার পরে। ট্রেন নির্দিষ্ট ১৭ নম্বর পয়েন্টের আগেই লাইনচ্যুত হয়েছিল। এতে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া এবং অন্তর্ঘাত নিয়ে আশঙ্কা বেড়েছে। লাইন পরীক্ষা করার সময়ে ১৭ নম্বর পয়েন্টের কাছে নির্দিষ্ট ‘টাং’ এবং ‘স্টক’ রেলের মধ্যে অনেকখানি ফাঁক দেখা গিয়েছে। এমন হলে চাকা বেলাইন হবেই।

ফলে অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখতে হচ্ছে। তবে কেন সব কিছু ঠিকমতো পরীক্ষা করা হয়নি, স্টেশন মাস্টার এবং সিগন্যালিং বিভাগের আধিকারিককে সেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে বলে খবর। রেলের সময়ানুবর্তিতার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারা, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে ভুল করা— ঠিক কী হয়েছিল? উত্তরখোঁজা চলছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Coromandel Express accident CBI Coromandel Express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy