—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করেছিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর। বৃহস্পতিবার সকালেও একের পর এক ফোন পেয়েছেন তিনি। নানারকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার কেন সুপ্রিম কোর্ট আর জি কর কাণ্ডে রায় ঘোষণা করল না? কেন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রায় দিতে দেরি করছেন? বৃহস্পতিবার শুনানি না হওয়ার পিছনে কি কারও চাপ রয়েছে?
প্রধান বিচারপতির অসুস্থতার জন্য বৃহস্পতিবার আর জি কর-কাণ্ডের মামলার শুনানি হয়নি। তবে সোমবারই দিনের শুরুতে এই মামলার শুনানি হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার শুনানি না হওয়া নিয়ে যে অযৌক্তিক জল্পনা শুরু হয়েছে, তাতে শীর্ষ আদালতের আইনজীবীরা শঙ্কিত। তাঁদের মতে, এই মামলার শুনানি ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রবল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তার ফলে শুনানি না হওয়াতেও নানা জল্পনা ছড়িয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন অনেকে।
আর জি কর-কাণ্ডের মামলার সঙ্গে যুক্ত এক আইনজীবী বলেন, ‘‘অনেকেই বোধহয় ভেবে নিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টই আর জি কর হাসপাতালের খুন-ধর্ষণের ঘটনা বা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত দোষীদের সাজা ঘোষণা করবে। বাস্তবে আদৌ তা নয়। আর এই অবাস্তব ধারণার ফলেই সুপ্রিম কোর্টের এই শুনানিতে কী হবে, তা নিয়ে প্রবল প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। আর সেই কারণেই এক দিন শুনানি না হওয়ায় নানা রকম ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়াতে শুরু করেছে। প্রধান বিচারপতি কেন বৃহস্পতিবার আদালতে বসতে পারলেন না, তা নিয়ে সবাই নিজের মতো কারণ খাড়া করছেন। বৃহস্পতিবার কোনও রায় ঘোষণাও হওয়ার ছিল না।’’
কলকাতা হাই কোর্ট প্রথমে আর জি করে তরুণী ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। তার পরে আর্থিক অনিয়মেও সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের তদন্তেই সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার করে সিবিআই। এই তদন্তের বিরুদ্ধে সন্দীপ সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছেন। শুক্রবার প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বসলে সেটির শুনানি হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের এক আইনজীবী বলেন, ‘‘অনেকের ধারণা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি পিছিয়ে গেলে সিবিআই তদন্তে বাধা পড়বে। একেবারে ভুল ধারণা। সিবিআই নিজের মতো তদন্ত করছে। সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে তদন্তের অগ্রগতি রিপোর্ট মুখ বন্ধ খামে জমা দিতে বলেছে। শুনানি পিছিয়ে গেলেও তদন্ত থেমে থাকছে না। আর জি কর কাণ্ড নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে অন্য কোনও মামলা হতে পারবে না, এমনও কোনও বাধা নেই।’’
আর জি করের প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে ‘আসল অপরাধী’-দের সাজার দাবি উঠেছে। আইনজীবীরা বলছেন, আসল অপরাধীদের খুঁজে বার করতে হবে সিবিআইকে। সিবিআই যদি কলকাতা পুলিশ, রাজ্য প্রশাসন বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ তোলে? আইনজীবীদের জবাব, সে ক্ষেত্রে সিবিআইকে সেই অভিযোগ প্রমাণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তা বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনও নির্দেশ দিতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে কী জানাচ্ছে, কার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছে, সেই অভিযোগের কতখানি বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, তার উপরে। সুপ্রিম কোর্ট কলকাতা পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত ঠিক মতো হয়েছিল কি না, সে ক্ষেত্রে কোনও গাফিলতি ছিল কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। আইনজীবীরা মনে করছেন, এ বার তদন্তে নজরদারির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট কিছু পদক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট কখনও সিবিআইকে বলে দিতে পারবে না যে আসল অপরাধী কারা বা কাদের গ্রেফতার করতে হবে।
দেশের শীর্ষ আদালতে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের এক আইনজীবী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রথমেই কোনও অপরাধীদের শাস্তি দেয় না। খুন-ধর্ষণ বা আর্থিক অনিয়ম, সবই প্রথমে নিম্ন আদালতে বিচার হবে। খুন-ধর্ষণের মামলার বিচার হবে কলকাতার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে। আর্থিক অনিয়মের বিচার বিশেষ সিবিআই আদালতে হবে। প্রথমে সিবিআই চার্জশিট পেশ করবে। তার পরে চার্জ গঠন হবে। তার পরে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে কেউ হাই কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবার সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার দরজা খোলা থাকছে। ফলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যাঁরা বিচার চেয়ে রাস্তায় নামছেন, তাঁদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে হবে।
উদাহরণ হিসেবে দিল্লির নির্ভয়া-কাণ্ডে গণধর্ষণের ঘটনা তুলে ধরছেন আইনজীবীরা। ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বরের এই ঘটনায় দিল্লির নিম্ন আদালত দোষীদের ফাঁসির সাজা শুনিয়েছিল ২০১৩-র ১৩ সেপ্টেম্বর। সেই রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টে মামলা হয়। হাই কোর্ট ২০১৪-র ১৪ সেপ্টেম্বর ফাঁসির সাজা বহাল রাখে। সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির বিরুদ্ধে আবেদন খারিজ করতে পাঁচ বছর সময় নেয়। ২০১৯-এর ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির আদেশই বহাল রাখে। চার মাস পরে চার জনের ফাঁসি হয়।
সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আর জি কর কাণ্ডের মামলার শুনানি শুরু করেছিলেন। কারণ এই ঘটনায় সার্বিক ভাবে সরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। দেশ জুড়ে চিকিৎসকেরা বিক্ষোভ শুরু করায় স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্যা তৈরি হয়। তাঁদের কাজে ফেরাতে শীর্ষ আদালত থেকে বার্তা দেওয়া দরকার ছিল। সুস্থতার জন্য প্রধান বিচারপতি শুধু বৃহস্পতিবার নয়, সোমবার থেকেই আদালতে বসতে পারেননি। কিন্তু তিনি আগেই ডাক্তার তথা হাসপাতালের নিরাপত্তা বাড়ানো নিয়ে নির্দেশ দিয়েছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy