—প্রতীকী ছবি।
এক মুহূর্তের জন্যও ক্যামেরার সামনে থেকে সরা যাবে না। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের ক্যামেরা চালু রাখতে হবে সর্বক্ষণ। নির্দেশমতো অ্যাপ ‘ডাউনলোড’ করে দূর থেকে সেই ক্যামেরায় নজরদারি করতে দিতে হবে। বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকলে জানাতে হবে সেই ক্যামেরার আইডি এবং পাসওয়ার্ড। নিস্তার নেই শৌচাগারেও। সেখানেও চালু করে যেতে হবে ফোনের ক্যামেরা!
টানা দু’দিন। এ ভাবেই এক আইনজীবীকে নিজের বাড়িতে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ (ভয় দেখিয়ে ক্যামেরাবন্দি করা) করে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাড়িতে বাইরের লোকের আসা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। খবরের কাগজ বা দুধ এলেও দরজা না খোলার নির্দেশ ছিল। পরিস্থিতি এমন হয় যে, নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিতে হয় তরুণীকে। ভুয়ো গ্রেফতারির অঙ্গ হিসেবেই তাঁকে এর পরে পোশাক খুলিয়ে ভুয়ো ‘নার্কো পরীক্ষা’ও করানো হয় বলে অভিযোগ!
প্রতারণা কোন পথে
১। ডিজিট্যাল গ্রেফতারি: ভয় দেখিয়ে ক্যামেরাবন্দি করে যা খুশি করানো, পরে টাকা হাতানো
২। বাড়ি বসে কাজ: লিঙ্কে ক্লিক করলেই টাকা! এগিয়ে সর্বস্ব খোয়ানো
৩। বিনিয়োগ: অ্যাপ নির্ভর গ্রুপে যুক্ত করিয়ে বিনিয়োগের নামে টাকা হাতানো
৪। পরিচয় চুরি: আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সাহায্যে নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর ভিডিয়ো, অডিয়ো বানিয়ে টাকা হাতানো
৫। ভাইরাস: ফোন বা ল্যাপটপ-কম্পিউটার বিকল করে দিয়ে সর্বস্বের দখল নেওয়া
৬। অনলাইন তোলা: ভিডিয়ো কল করে অশ্লীল ছবি, ভিডিয়ো দেখিয়ে হুমকি, টাকা তোলা
মুম্বই পুলিশকে ২৯ বছরের ওই তরুণী জানান, একটি আন্তর্জাতিক ক্যুরিয়র সংস্থা থেকে সম্প্রতি ফোন পান তিনি। তাঁকে বলা হয়, তাঁর পাঠানো ক্যুরিয়র ধরে রাখা হয়েছে। সংস্থার কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন করে বাকিটা জানানো হবে। এর পরে কাস্টমার কেয়ারের নাম করে ফোন করা হয় তরুণীকে। তাঁকে বলা হয়, তাঁর পাঠানো ক্যুরিয়রে পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গেই পাওয়া গিয়েছে ‘সিন্থেটিক ড্রাগ’ এমডিএমএ-র ১৪০টি ট্যাবলেট। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে পুলিশের সঙ্গে কথা বলা উচিত বলে জানানো হয় ওই কাস্টমার কেয়ার থেকে। তারাই মুম্বই পুলিশের নম্বর দিচ্ছে বলে একটি ফোন নম্বর দেয়। ওই নম্বরে ফোন করেই এর পর জালে জড়াতে থাকেন তরুণী। পুলিশের পোশাকে গ্রেফতারির নানা নথি দেখিয়ে ভয় দেখানো শুরু হয় তরুণীকে। সেই সূত্রেই তাঁকে জানানো হয়, ‘‘আপনাকে ডিজিটাল অ্যারেস্ট করা হল!’’ আইনজীবী হয়েও যা কেটে বেরোতে পারেননি তরুণী। টানা দু’দিন ওই ভাবে কাটানোর পরে ১৪ লক্ষ টাকা দিয়ে মুক্ত হন তিনি।
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে দেশের সাইবার প্রতারণার জগতে অন্যতম আতঙ্কের নাম ‘ডিজিটাল অ্যারেস্ট’ বা ডিজিটাল গ্রেফতারি। সাধারণ মানুষ তো বটেই, প্রতারিতদের তালিকায় আইনজীবী, শিক্ষক, সাহিত্যিকের পাশাপাশি রয়েছেন বহুজাতিক সংস্থার কর্তারাও। অনেক ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হচ্ছে ভুয়ো ওয়ারেন্টও। কিছু দিন আগেই পরমাণু গবেষণা সংস্থার পদস্থ কর্তা এই ফাঁদে পড়ে ৭১ লক্ষ টাকা খুইয়েছেন বলে অভিযোগ। একটি জ্বালানি সংস্থার পদস্থ কর্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকেও এই ভাবে প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ঘোষণা করতে হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে গ্রেফতারির কোনও আইনই নেই। পুরোটাই ভুয়ো। তবে এর পরেও আতঙ্ক কাটছে না।
কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল— এই চার মাসের মধ্যে ‘ডিজিটাল অ্যারেস্টে’-এর ফাঁদে পড়ে ১২০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা খোয়া গিয়েছে ভারতীয় নাগরিকদের। মোট প্রতারণা হয়েছে ১৭৫০ কোটি টাকার। ডিজিটাল অ্যারেস্ট ছাড়াও লগ্নির টোপে পড়ে খোয়া গিয়েছে ২২২ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। ব্রান্ডিংয়ের টোপে এবং বন্ধুত্বের অ্যাপে খোয়া গিয়েছে যথাক্রমে ১৪২০ কোটি এবং ১৩ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা। ‘ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টাল’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে যেখানে সাইবার প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছিল চার লক্ষ, সেখানে ২০২২ সালে জমা পড়েছে প্রায় ন’লক্ষ অভিযোগ। ২০২৩ সালে সাইবার প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে ১৫ লক্ষ। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ৭ লক্ষ ৪০ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে গিয়েছে। সাইবার বিশেষজ্ঞদের দাবি, সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে অনেক ঘটনাই পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছয় না। সেই সব ঘটনা ধরলে আরও বেশি সংখ্যায় টাকা সাইবার প্রতারকদের হাতে গিয়েছে। সাইবার বিশেষজ্ঞ তথা ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং’-এর ডিরেক্টর সন্দীপ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘মূলত ভয় আর প্রলোভনকে হাতিয়ার করে ফাঁদ পাতা হচ্ছে।’’ সন্দীপ জানান, ‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স মেশিন লার্নিং’ এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে যে কারও ছবি-ভিডিয়ো দিয়ে যা খুশি বানিয়ে ফেলা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘‘কেউ হয়তো বেড়াতে যাওয়ার ছবি সমাজমাধ্যমে দিলেন। এতে প্রতারকদের চোখে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। হয়তো কেউ পুরী বেড়াতে যাচ্ছেন লিখেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এমন ভিডিয়ো তৈরি করা সম্ভব, যেখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে বলছেন যে তাঁর সমস্ত কিছু খোয়া গিয়েছে। বাড়ি ফিরতে টাকার প্রয়োজন। কাউকে পেয়ে গিয়েছেন। তিনি নিজের অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে সাহায্য করতে রাজি আছেন। তাতেই যেন টাকা পাঠানো হয়। এ বার অনেকেই বন্ধুর বিপদ বুঝে টাকা দেবেন। কিন্তু সেই বন্ধু যে কোনও সমস্যায় পড়েননি তা যাচাই করা হচ্ছে না।’’ এই ভাবেই সন্তান বিপদে পড়েছে বা তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সন্তানের মতো অবিকল কণ্ঠস্বর শুনিয়ে ফোন করা হচ্ছে অভিভাবকদের। এ ক্ষেত্রেও ভয়ই হাতিয়ার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy