বিএসএফের সাহায্যে ভোল পাল্টেছে মুহর জামশের গ্রামের স্কুল। —নিজস্ব চিত্র।
সীমান্তে যুদ্ধ বাধে, ‘মালিকানা’ বদলে যায় মুহর জামশের-এর! ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১। কখনও কার্গিল, কখনও উরি। পঞ্জাব-রাজস্থান সীমান্তে ভয়ে কাঁটা হয়ে দিনরাত কাটে একচিলতে গ্রামের।
আসলে ডানে ঘুরলে পাকিস্তান। বাঁয়ে তাকালেও তা-ই। সামনে এগোলেও সঙ্গিন উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাক রেঞ্জার্স। রইল বাকি যে একটি দিক, সে দিকেও শতদ্রু নদী ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে এ যাবৎ আলাদা করে রেখেছিল ফাজিলকা জেলার গ্রাম মুহর জামশেরকে। কার্যত পাকিস্তানের কোলে বসে থাকা, পঞ্জাবের এই সাবেক ছিটমহল এখন ভারতের মানচিত্রে জ্বলজ্বল করলেও গ্রামের ভাগ্য নিয়ে গত সত্তর বছরে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে বিস্তর। স্বাধীনতার পর থেকে বঞ্চনার ইতিহাস বহন করে আসা মুহর জামশেরের ছবি বদলে দিয়েছে একটি মাত্র সেতু। শতদ্রুর উপরে যে সেতুকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে হাজারখানেক জনসংখ্যার এই গ্রাম।
দেশভাগের সময়ে ভারতের সঙ্গে জুড়ে গেলেও যোগাযোগের অভাবে কার্যত এক প্রান্তে পড়ে ছিল মুহর জামশের। তারই পুরোদস্তুর সুযোগ নিয়ে ১৯৬৫-র যুদ্ধের সময়ে গ্রাম ঘিরে বসে ছিল পাক সেনা। ১৯৭১-এ তো গ্রাম দখলই করে নেয় তারা। বাংলাদেশ যুদ্ধে পঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে আক্রমণ শানিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। মুহর জামশের-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা চলে যায় তাদের হাতে। যুদ্ধ শেষে হয় শিমলা চুক্তি। দখলদারমুক্ত হয় মুহর জামশের।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সেই ছয় থেকে আট মাসের অভিজ্ঞতা এখন মনে রয়েছে গুরুবচন সিংহের। বছর পঁয়ষট্টির গুরুবচন সে সময়ে তরতাজা যুবক। তাঁর কথায়, “যুদ্ধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিলাম। বাড়ি-ঘর, খেত-খামার, গবাদি পশু, সব ছেড়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। ফিরে এসে দেখি, বাড়িঘরও ভেঙে দিয়েছে পাক সেনা। কার্যত নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কখনও চাইব না, সেই পরিস্থিতি ফিরে আসুক।”
না-চাইলেও, বারবার ফিরে এসেছে অনিশ্চয়তা। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ, কিংবা হালের ২০১৬ সালের প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইক— ফের বাড়িঘর ফেলে পালাতে হয়েছিল গুরুবচনদের। এ বার বায়ুসেনার বালাকোট অভিযানের পরে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। বলে দেওয়া হয়েছিল, আধ ঘণ্টার নোটিসে গ্রাম খালি করতে হতে পারে। কিন্তু সদ্য গড়ে ওঠা সেতুর কল্যাণে প্রচুর সংখ্যায় বিএসএফ জওয়ানের মোতায়েন ও লাগাতার টহল দেখে এ বার সাহস করে আর ঘর ছাড়েননি গুরুবচন ও তাঁর পরিবার। দেখাদেখি অন্যরাও। তিনি বলেন, ‘‘ওই পারে কিন্তু গ্রাম খালি হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মসজিদে ইমাম পর্যন্ত ছিলেন না।’’
চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ রুখতে সীমান্তে প্রথম যখন কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়েছিল, তখন এই গ্রামকে বাইরে রেখেই বসেছিল সেই বেড়া। ফলে ভারতের অংশ হয়েও দেশের বাইরে পড়ে যায় মুহর জামশের। কেন এমনটা হয়েছিল, সেই উত্তর গ্রামবাসী বা প্রশাসন, কারও কাছে নেই। কার্যত অরক্ষিত থাকায় এক দিকে যেমন নিত্যদিন পাকিস্তানি হানাদারদের শিকার হয়েছে এই গ্রাম, তেমনই রাতবিরেতে কেউ অসুস্থ হলে ফাজিলকায় পৌঁছতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে গ্রামবাসীদের। এমনকি গ্রামের বিবাহযোগ্য ছেলেদের জন্য মেয়ে পাওয়াও রীতিমতো সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নদী পেরিয়ে ভোট দিতে যাওয়াও ছিল ঝকমারি।
রাজ্যে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেই শতদ্রুর উপরে তৈরি করেছে পাকা সেতুটি। দীর্ঘ দাবি পূরণে চওড়া হাসি গ্রামবাসীদের মুখে। বলছেন, “যারা কাজ করবে, ভোট তারাই পাবে। এ বারের ভোট, প্রতিদানের ভোট।” শুধু মুহর জামশেরই নয়, ফাজিলকা, ফিরোজপুর, জালন্ধর, গুরুদাসপুর ঘুরে যা বোঝা গেল, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়া বিজেপি-অকালি জোটের পক্ষে লোকসভা ভোটে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ মুশকিল। বিশেষ করে শিরোমণি অকালি দলের স্বজনপোষণে যারপরনাই বিরক্ত পঞ্জাবের সাধারণ মানুষ। ক্ষমতায় এসেই ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের কৃষিঋণ মাফ ও মাদক চোরাচালান বন্ধে কড়া পদক্ষেপে খুশি আমজনতা। তাই রাজ্যের ১৩টি লোকসভা আসনের অন্তত ১০টি জেতার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়েছে কংগ্রেস। সেতুটা হওয়ায় কার্যত এই প্রথম বার লোকসভা ভোটের কোনও প্রার্থী পা রাখবেন মুহর জামশেরে। শোনা যাচ্ছে, মাস তিনেক আগে অকালি দল ছেড়ে আসা রাইশিখ গোষ্ঠীর নেতা শের সিংহ গুবায়াকে ফিরোজপুর আসনে প্রার্থী করবে কংগ্রেস। সে ক্ষেত্রে তিনি এই গ্রামে প্রচারে আসবেন বলে খবর। মুহর জামশেরের গ্রামবাসীরা রাইশিখ গোষ্ঠীরই। অতএব ‘অ্যাডভান্টেজ শের সিংহ’।
মুহর জামশেরকে সত্যিই বদ্ধ দশা থেকে মুক্তির স্বাদ দিয়েছে ওই সেতু। সরাসরি যোগাযোগ তৈরি হয়েছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। তার আগেই গ্রামের চারপাশে বসেছে নতুন কাঁটাতারের বেড়া। পাক সমাজবিরোধীদের উৎপাত নেই। ফাজিলকা টাউনে পড়তে যাচ্ছে গ্রামের মেয়েরা। গুরুবচনের নাতনি মিঠ্ঠু এখন ফাজিলকা বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সেখানেই হস্টেলে থাকে সে। আর গ্রামের যে স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি অবধি মিঠ্ঠু পড়েছে, সেই স্কুলের দেখা মিলল গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। গ্রামের শেষ বাড়ি সেটিই। তার পরেই শুরু হয়েছে চাষের জমি। প্রায় ৫০০ গজ ধান-গমের খেতের পরেই কাঁটাতারের বেড়া। তার ও-পারে পাকিস্তানের পোস্ট।
গত পনেরো বছর ধরে ওই গ্রামের স্কুলেই শিক্ষকতা করছেন বছর চল্লিশের জিতেন্দ্র সিংহ। সেতু হওয়ার আগে স্কুলে পৌঁছতে নাজেহাল হতে হত। জিতেন্দ্রের কথায়, ‘‘বর্ষায় তো স্কুলে আসাই যেত না। অনেক সময়ে স্কুলে এলেও ফিরে যেতে পারিনি নদীতে জল বেড়ে যাওয়ায়। একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে হওয়ায় আগে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পেতেন বাবা-মায়েরা। সে সমস্যা এখন আর নেই।’’ স্কুলটির পরিকাঠামো উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে বিএসএফ-ও। ছোট পড়ুয়াদের খেলার সরঞ্জাম থেকে এলসিডি বোর্ড, ফি-বছর স্কুলের উন্নয়নে হাত বাড়িয়েছে তারা। সব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের শীতঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে মিঠ্ঠুদের প্রজন্ম। পারিবারিক চাষবাসের বাইরেও নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখছে তারা। মিঠ্ঠুর ইচ্ছে, বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হবে। কিংবা বিএসএফেই যোগ দিয়ে সাহস জোগাবে নিজের গ্রামের মানুষগুলোকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy