ছবি: এপি।
“কী মৃন্ময়দা, হাউ ইজ় দ্য জোশ?”
অফিস যাওয়ার পথে সুরেনদার চায়ের দোকানে জবুথুবু হয়ে বসে থাকা মৃন্ময়দার দিকে ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল সুবিনয়। ইদানীং সেনাবাহিনীর এই ‘ব্যাটল ক্রাই’ উরি-দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক সিনেমার সৌজন্যে একটি জনপ্রিয় সংলাপ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে আরম্ভ করে নাকে জীবনদায়ী নল লাগানো অবস্থায় সদ্য প্রয়াত গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীকে জনসভায় এই সংলাপ আমরা বলতে শুনেছি। সেনাবাহিনীর কমান্ডারের এই সংলাপের জবাবে তাঁর অধীনস্থ সেনারা বুক উঁচিয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে সমস্বরে উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, “হাই স্যার।” অর্থাৎ আমরা জানপ্রাণ দিয়ে আগত যুদ্ধ লড়ার জন্য প্রস্তুত।
ভোটের ময়দানে যুদ্ধ জয়ের জন্য কতটা প্রস্তুত পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক সেনারা, অর্থাৎ মৃন্ময়দা, তুষারদার মতো সাধারণ দলীয় কর্মী ও সমর্থকেরা? মৃন্ময়দাকে দেখে চিত্রটা এ বার যেন একটু অন্য রকম মনে হল। চিরকাল সুরেনদার দোকানটা ছিল রাজনীতি আলোচনার আখড়া। ভোটের মুখে কোনও পার্টি অফিসের চেয়ে কম সরগরম থাকত না। মৃন্ময়দা, তুষারদারা নিজের নিজের দলের এক কালে দাপুটে ভোটকর্মী ছিলেন। বড় রাস্তা থেকে আরম্ভ করে পাড়ার প্রতিটি অলিগলিতে মাইলের পর মাইল দলের সমর্থন জোগাড় করতে হাঁটতেন। সন্ধেবেলায় রাস্তার কোণায় গুটিকতক প্লাস্টিকের চেয়ার জুটিয়ে সভা করতেন, রাত্রে দেওয়াল লিখতেন, সকালে গৃহস্থের কড়া নেড়ে প্রচারপত্র হাতে নিয়ে প্রার্থীর গুণগান করতেন। বাড়ি-বাড়িতে পার্টির ভোটার স্লিপ বিলি করার সময় ভাঙা গলায় হাত জোড় করে বলতেন, “সকাল সকাল ভোটটা দিয়ে আসবেন।”
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
দল নির্বিশেষে পাড়ায় পাড়ায় মৃন্ময়দা বা তুষারদার মতো দলীয় কর্মী ও সমর্থকেরা আজ কেমন যেন বিভ্রান্ত। চিরাচরিত ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক প্রচারটা এ বার নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতির ঘোষণায় কোথায় যেন তাল বেতাল হয়ে যাচ্ছে। অথচ সাধারণ মানুষের কাছে এঁরাই দলের মুখ। অবশ্য ইতিহাস থেকে দীক্ষিত হয়ে সাধারণ ভোটাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব বা বাস্তবতা কতটা বোঝেন। কিন্তু মৃন্ময়দা, তুষারদারা বুঝে উঠতে পারছেন না ভোটার স্লিপ হাতে সুবিনয়দের মতো সাধারণ ভোটারদের দরজায় কড়া নেড়ে এ বার যখন মুখোমুখি হবেন, তখন তাদের মনে ওঠা প্রশ্নগুলোর কী উত্তর দেবেন? অথচ ভোটের আবহে যথারীতি রাজনৈতিক নেতারা দলীয় কর্মীদের মধ্যে জোশ-টা উস্কে দিতে চাইছেন। মৃন্ময়দাদের মধ্যে দিয়ে সাধারণ ভোটারদের কাছে প্রতিশ্রুতির উত্তাপটা সঞ্চারিত করে দিতে চাইছেন।
“সারদার টাকা ফেরত পাইনি, বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা কালো টাকার ভাগ আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢোকেনি, এ বার ৬ হাজার টাকা পাব তো?” স্বয়ং সুরেনদার চা ছাঁকতে ছাঁকতে এই প্রশ্নের উত্তরে মৃন্ময়দা মাথা নামিয়ে নিয়েছেন। কোনও সদুত্তর নেই। গত ভোটের প্রতিশ্রুতি মতো বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে এনে সাধারণ দেশবাসীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় কী হল? উল্টে আমরা দেখেছি বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিদের। কোটি কোটি টাকার তছরুপ করে বিদেশের মাটিতে লক্ষ টাকার জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে মুচকি হাসির ছবি বিলিয়ে যেন মৃন্ময়দাদের ব্যঙ্গ করছেন।
আর এক দিকে কংগ্রেস সভাপতি সেই পুরনো ‘গরিবি হটাও’ প্রতিশ্রুতির রূপরেখা নতুন মোড়কে ‘সামাজিক ন্যায়’ ঘোষণা করেছেন। ক্ষমতায় এলে জাত-পাত-ধর্ম শহর গ্রাম নির্বিশেষে ৫ কোটি গরিব পরিবারকে মাসে ৬ হাজার টাকা দেবেন। অর্থাৎ সরকারি কোষাগার থেকে বছরে ৩ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা এই প্রকল্পে বরাদ্দ হবে। সরকার এই টাকার সংস্থান কী ভাবে করবে, সুরেনদা মাসে ৬ হাজার টাকা সত্যিই পাবে কিনা, পক্ষে এবং বিপক্ষে এই নিয়ে বহু আলোচনা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শুধু সুরেনদার প্রশ্নতেই নয়, দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে ঢোঁক গিলতে হচ্ছে মৃন্ময়দাদের। এই প্রকল্প যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয় তা হলে আয়করের হার, জিএসটির বোঝা আরও বেড়ে যাবে কি না, সুবিনয়ের মতো সাধারণ ভোটারের মনে উঁকি দেওয়া এই সব অস্বস্তিকর প্রশ্নের কোনও সদুত্তর নেই।
নীরব মোদীদের অবশ্য আমরা প্রথম দেখছি না। অতীতে আমরা হর্ষদ মেহতা, কেতন পারেখ, রামালিঙ্গম রাজু, তেলগি, সুদীপ্ত সেন প্রমুখদের দেখেছি। ভোটের সময় যথাক্রমে এই সব আর্থিক কেলেঙ্কারি ইস্যু হয়েছে। সেই সব ইস্যুকে কী ভাবে যুঝতে হবে, মৃন্ময়দা, তুষারদারা দলীয় প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এ বার কোথায় যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনবরত বয়ে চলেছে, নানা মুনির নানা বিশ্লেষণ, অপপ্রচার আর মিম।
মৃন্ময়দাদের বিভ্রান্তি আরও আছে। ভোটের লড়াইটা আসলে এ বার কিসের সঙ্গে কিসে? হিন্দুত্ববাদী বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি উগ্র জাতীয়তাবাদী বনাম সহনশীলতার? অটলবিহারী বাজপেয়ী দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনতিকাল পরেই পোখরানে পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেশকে শক্তিশালী প্রমাণ করেছিলেন। এর বহু বছর আগে ইন্দিরা গাঁধী সেই পোখরানেই একই রকম পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। কোনও দেশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হলে বহু আন্তর্জাতিক চাপের মোকাবিলা করতে হয়। জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষ সে চাপ সামলিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে এই সব জাতীয়বাদী শক্তি সঞ্চয় কখনও ভোটের প্রধান ইস্যু হয়নি। সম্প্রতি দেশকে মহাকাশ যুদ্ধে শক্তিশালী করতে দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কৃত্রিম উপগ্রহকে ধ্বংস করার প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ করে দেখাল। ঘটনাচক্রে সেটা হল ভোট শুরু হওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে এবং যথারীতি এই জাতীয় সাফল্য সরকারের মুকুটে পালক হয়ে ভোটের জাতীয়তাবাদী ইস্যু হয়ে গেল। তথ্য ঘেঁটে মৃন্ময়দারা যতই বলার চেষ্টা করুন এই প্রকল্পের ভাবনা ও বরাদ্দ হয়েছিল ২০১০ সালে যখন এই সরকার ক্ষমতাতেই ছিল না, সরকারি ‘জোশ’-এর কাছে তাঁদের কণ্ঠস্বর নেহাতই ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে।
লড়াইয়ের ইস্যুগুলোই আসলে বড় অদ্ভুত। ‘মিশন শক্তি’ বনাম ‘সামাজিক ন্যায়’। তার মধ্যেই মরিয়া ‘জোশ’ খুঁজে চলেছেন রাজনৈতিক সব পক্ষই। তাই উরি সিনেমার ‘ব্যাটল ক্রাই’ এখানে বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে। উরির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সেনার সফল সার্জিকাল স্ট্রাইক হয়েছিল ২০১৬ র সেপ্টেম্বর মাসে। তার সাফল্য নিয়ে দেশবাসীর মনে কোনও সংশয় ছিল না। জাতীয়তাবাদের একটা জোশ উঠেছিল। কিন্তু সেই জোশ ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। কারণ দু’মাসের মধ্যে দেশবাসীকে গ্রাস করেছিল নোটবন্দির আতঙ্ক। ৫০০ ও ১০০০ টাকার ওপর সেই সার্জিকাল স্ট্রাইকের সাফল্য ও দুর্ভোগের পর কেটে গিয়েছে আরও আড়াইটা বছর। মধ্যবর্তী সময়ে ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি রাজ্যের নির্বাচন। তার ফলাফল আমরা জানি। এর পর বছরের শুরুতে ঘটে গেল পুলওয়ামায় বীভৎস জঙ্গি হামলা এবং ভারতীয় বিমানবাহিনীর এয়ার স্ট্রাইক যেটা সার্জিকাল স্ট্রাইক-২ বলা হচ্ছে। ঘটনাক্রমে এর কাছাকাছি সময়েই মুক্তি পেয়েছে উরি-দ্য সার্জিকাল স্ট্রাইক সিনেমাটি। প্রথম সার্জিকাল স্ট্রাইকের সাফল্য নিয়ে দেশবাসীর মনে যে রকম কোনও সংশয় ছিল না, দ্বিতীয় সার্জিকাল স্ট্রাইকের সাফল্য এবং ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান নিয়ে অনেকে সন্দিহান। ক্ষমতাসীন দল কিন্তু সগর্বে “হাউ ইজ় দ্য জোশ?” এর পূর্বতন সাফল্য দিয়ে সব সন্দেহের নিরসন করতে চাইছেন এবং দলীয় অনুগামীদের একাংশ এই নিয়ে কোনও প্রশ্নকেই দেশদ্রোহিতার তকমা দিচ্ছেন। বিরুদ্ধ মত বা মুক্তকণ্ঠকে লাঞ্ছিত করছেন। উৎপন্ন হচ্ছে এক বিষের হাওয়া। দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ছে। কাশ্মীরি শালওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ফেরি করতে বা সুরেনদার দোকানে বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে ভরসা হারাচ্ছেন।
মৃন্ময়দারা তাই ভেবে উঠতে পারছেন না কী ভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুঝবেন। এক দিকে গালভরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর এক দিকে জাতীয়তাবাদী একাত্মতাকে জাত, ধর্ম, ভাষা, রাজ্যে ভেঙে টুকরো টুকরো করা। লড়াইটা যদি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে হয়, তা হলে কোন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক ব্যক্তি স্বার্থের জন্য বিরোধীদের আসন সমঝোতা হচ্ছে না, মৃন্ময়দাদের জানা নেই।
আসলে ভোট আসে ভোট যায়। নেতা আসে নেতা যায়। নাম পাল্টে যায়। বফর্স হয়ে যায় রাফাল। হর্ষদ মেহতা হয়ে যায় নীরব মোদী। উরি হয়ে যায় পুলওয়ামা। মৃন্ময়দা, তুষারদার মতো অনুগত রাজনৈতিক সেনারা পাল্টান না। পাল্টায় না তাদের আত্মশ্লাঘা, ‘আমরা ভোট করাই।’ ওঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত। ভোটের সময় জোশে টগবগ করার জন্য মুখিয়ে থাকে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ। ওঁদের এই অন্তরটাই না দেখতে পান সাধারণ মানুষ, না ওঁদের রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy