মুখে যে যা-ই বলুন, বুথফেরত সমীক্ষার দেওয়া আভাসকে নস্যাৎ করতে পারছেন না কেউই। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
এক শিবিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস, হাসির রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠার ইঙ্গিত। অন্য শিবিরে আচমকা যেন ভাটার টান তৎপরতায়, সমীকরণ গঠনের খেলায় হঠাৎ যেন আব্বুলিশ। বুথফেরত সমীক্ষায় মেলা আভাস কতটা প্রভাব ফেলেছে দেশের রাজনীতিতে, যুযুধান দু’পক্ষের মেজাজে মেঘ-রোদের খেলায় বেশ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে তা। শুরু হয়ে গিয়েছে ইভিএম কারচুপির আশঙ্কা প্রকাশ করাও।
অধিকাংশ সমীক্ষার ইঙ্গিত, ৩০০-র বেশি আসন জিতে সরকার ধরে রাখছে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ। দু-একটি সমীক্ষায় এনডিএ-কে ৩০০-র বেশ কিছুটা কম আসনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনডিএ পাবে না— এমন আভাস কোনও সমীক্ষাই দেয়নি।
বিরোধী শিবিরের প্রায় সব নেতাই বুথফেরত সমীক্ষার দেওয়া পূর্বাভাসকে নস্যাৎ করেছেন। বহু বারই যে এই সব সমীক্ষার দেওয়া আভাস ভুল প্রমাণিত হয়েছে, সে কথা তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দিল্লিতে অ-বিজেপি সরকার গঠনের উপযুক্ত রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি করার জন্য যে তৎপরতা শুরু হয়েছিল বিরোধী শিবিরে, তা আচমকা থমকে গিয়েছে। একা কুম্ভ হয়ে সে তৎপরতা জিইয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা তেলুগু দেশম সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মঙ্গলবার এনডিএ-র সব শরিককে দিল্লিতে নিমন্ত্রণ করেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। অশোক হোটেলে ডিনার পার্টির আয়োজন করেছেন নরেন্দ্র মোদীর প্রধান সেনাপতি। ফলপ্রকাশ পরবর্তী স্ট্র্যাটেজি নিয়ে একদফা আলোচনা সেরে নিতেই যে শরিক দলগুলির নেতাদের এই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অমিত শাহ, তা নিয়ে রাজনৈতিক শিবিরের খুব একটা সংশয় নেই। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভোট শেষ হওয়ার পরে নয়, সব বুথফেরত সমীক্ষাগুলোর ফলাফল সামনে আসার পরে এই ডিনার পার্টির আয়োজন হয়েছে। বিজেপি সূত্রের খবর, মঙ্গলবারের নৈশভোজের টেবিলকে অঘোষিত ভাবেই বিজয় উদ্যাপনের টেবিল করে তুলবে বিজেপি। পরবর্তী সরকার গঠন নিয়ে প্রয়োজনীয় নানা আলোচনাও সেই আবহেই প্রাথমিক ভাবে সেরে নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন: ‘মধ্যপ্রদেশে সরকার সংখ্যালঘু’, বিশেষ অধিবেশন চেয়ে রাজ্যপালকে চিঠি বিজেপির
সমীক্ষার ফলাফল বিজেপি-কে স্বস্তিতে না রাখলে অমিত শাহ এই পার্টির আয়োজন করতেন কি না, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। এনডিএ গরিষ্ঠতায় পৌঁছতে পারছে না, এমন কোনও আভাস পাওয়া গেলে কিন্তু এই রকম তৃপ্ত ভঙ্গিতে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত কিছুতেই অপেক্ষা করতেন না অমিত শাহ। রবিবার রাত বা সোমবার সকাল থেকেই বিজেপির ক্রাইসিস ম্যানেজাররা সংখ্যা জোগাড়ের জন্য গোটা দেশে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিতেন সে ক্ষেত্রে। মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
আরও পড়ুন: সনিয়া-মায়া বৈঠক হচ্ছে না দিল্লিতে, মহাজোট কি টালমাটাল?
স্বাভাবিক ভাবেই গেরুয়া শিবিরের মেজাজে যে স্বস্তির রং, তার ঠিক বিপরীত ছবিটাই দেখা যাচ্ছে বিরোধী শিবিরের একটি অংশে। বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে এক ছাতার তলায় আনার বিষয়ে এখনই আর খুব একটা উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না কংগ্রেসকে। যে সব আঞ্চলিক বা রাজ্য দলের নেতা বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, রাহুল গাঁধী বা সনিয়া গাঁধী তাঁদের সঙ্গে দেখা করছেন ঠিকই। কিন্তু সরকার গড়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যে ধরনের তৎপরতা জরুরি, ১০ জনপথ বা ২৪ আকবর রোডে তা আপাতত অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন: বুথফেরত সমীক্ষা সামনে আসতেই শরিক দলের মন্ত্রীকে সরালেন যোগী
আচমকা যেন একটু সাবধানী বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) সুপ্রিমো তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও। গত এক-দেড় মাস ধরে বিজেপি-কে এবং মোদী-শাহ জুটিকে একের পর এক ইস্যুতে অত্যন্ত চড়া ভাষায় আক্রমণ করছিলেন মায়া। শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশের বিষয় নিয়ে নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিজেপির সঙ্ঘাতের বিষয় নিয়েও মুখ খুলছিলেন বিএসপি সুপ্রিমো। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় বুথফেরত সমীক্ষার ফল সামনে আসার পর থেকে যেন একটু সাবধানী দলিত হৃদয়েশ্বরী। দিল্লি গিয়ে সনিয়া-রাহুলের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা আপাতত বাতিল করে দিয়েছেন মায়াবতী। উত্তরপ্রদেশে যাঁর হাত ধরে লড়লেন তিনি, সেই অখিলেশ যাদবকেও মায়ার দেখা পেতে হয়েছে তাঁর বাড়ি গিয়ে।
আরও পড়ুন: মমতা-চন্দ্রবাবু বৈঠক শেষ, আলোচনা জোট রণকৌশল নিয়ে
হাল ছাড়ছেন না শুধু চন্দ্রবাবু নায়ডু। শনিবার, রবিবার, সোমবার— দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত অক্লান্ত ছুটছেন তিনি। সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই-এর সুধাকর রেড্ডির সঙ্গে বৈঠক করেছেন নায়ডু। রবিবার প্রথমে লখনউ গিয়ে বৈঠক করেছেন এসপি সভাপতি অখিলেশ যাদব এবং বিএসপি সুপ্রিমো মায়াবতীর সঙ্গে। সে দিনই দিল্লিতে দু’বার বৈঠক করেছেন রাহুল গাঁধীর সঙ্গে, এক বার সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে। বৈঠক করেছেন এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ার, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তথা আম আদমি পার্টির (আপ) প্রধান অরবিন্দ কেজরীওয়াল এবং লোকতান্ত্রিক জনতা দলের প্রধান শরদ যাদবের সঙ্গেও।
সোমবার চন্দ্রবাবু নায়ডু এসেছেন কলকাতায়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। ভোটের ফল প্রকাশের পরবর্তী রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করতেই যে এই বৈঠক, তা-ও স্পষ্টই জানানো হয়েছে।
কেন এখনও শুধু শুধু নিজের ক্লান্তি বাড়াচ্ছেন চন্দ্রবাবু? কটাক্ষ ছুড়েছে বিজেপির শরিক শিবসেনা। দলের মুখপাত্র ‘সামনা’য় এই কটাক্ষ ছোড়া হয়েছে অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। কটাক্ষ বিজেপি-ও ছুড়েছে। বিদায়ী সরকারের মন্ত্রী তথা বেগুসরায়ের বিজেপি প্রার্থী গিরিরাজ সিংহের শ্লেষাত্মক মন্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে রাজনৈতিক আইসিইউ-তে চলে যাওয়া উচিত চন্দ্রবাবু নায়ডুর।’’ আর নিজের অবস্থান নমনীয় করে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেডি প্রধান নবীন পট্টনায়কের ইঙ্গিত, বিজেপি নিয়ে আপাতত কোনও ছুঁৎমার্গ নেই তাঁর। ওড়িশার উন্নয়নে যাঁরা সাহায্য করবেন, তাঁদের সঙ্গেই হাত মেলাতে প্রস্তুত— নবীনের এই মন্তব্যকে মোদীর প্রতি স্পষ্ট বার্তা হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
শেষ পর্যন্ত কার পক্ষে গেল দেশের রায়, সে কথা বৃহস্পতিবার বিকেলের আগে হলফ করে বলার অবস্থায় কেউই নেই। কিন্তু বুথফেরত সমীক্ষা যে একটা আবহ তৈরি করে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার অবস্থায় প্রায় কেউই নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা চন্দ্রবাবু নায়ডুরা এখনও বুথফেরত সমীক্ষাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করারই পক্ষপাতী। কিন্তু বিহারে বিজেপির ‘অবাধ্য’ শরিক নীতীশ কুমার ভোল বদলে ফেললেন ৪-৫ ঘণ্টার মধ্যে। শেষ দফার ভোটগ্রহণের দিন দুপুরেই নীতীশ আচমকা সুর চড়িয়েছিলেন বিজেপির বিরুদ্ধে। নাথুরাম গডসে সম্পর্কে সাধ্বী প্রজ্ঞার মন্তব্যকে হাতিয়ার করে আচমকা বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যার পরে অবস্থান সামলে নিয়ে খুব স্পষ্ট করে দিয়েছেন— এনডিএ ছাড়ার প্রশ্নই নেই। মুখে যে যা-ই বলুন, বুথফেরত সমীক্ষার দেওয়া আভাসকে নস্যাৎ করতে পারছেন না কেউই এবং ভোটের ফল প্রকাশের আগে পর্যন্ত ওই সমীক্ষার দেওয়া আভাসই নিয়ন্ত্রণ করছে জাতীয় রাজনীতির নানা স্রোতকে।
(দেশজোড়া ঘটনার বাছাই করা সেরাবাংলা খবরপেতে পড়ুন আমাদেরদেশবিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy