Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রবীণদের আইনি অধিকার

ভারতের আইনে সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের মর্যাদা-সহ বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রবীণদেরও উচিত নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া।

শ্রীরামপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রম। ছবি: দীপঙ্কর দে

শ্রীরামপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রম। ছবি: দীপঙ্কর দে

বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:১৪
Share: Save:

মহাভারতের যুদ্ধে পাণ্ডবরা কৌরবদের পরাজিত করে হস্তিনাপুর-সহ বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিকারী হন। এই বিস্তৃত সাম্রাজ্যে পঞ্চপাণ্ডবের মা কুন্তীর স্থান হয়নি। তাঁকে বাণপ্রস্থে যেতে হয়। অর্থাৎ বার্ধক্যকালে সুখ-শান্তি, আরাম-বিশ্রাম তাঁর জন্য নয়। নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাঁকে বাণপ্রস্থে যেতে হবে। এই ট্র্যাডিশন সর্বত্র বিরাজমান। দেশে বিদেশে সর্বত্র আজ বার্ধক্যে উপনীত মানুষ চরম অসহায়। গর্ভধারিণী মা সন্তানকে মানুষ করেন, স্বামীর সেবা করেন আর জীবনের শেষে চলে যেতে হয় মথুরা, বৃন্দাবন অথবা কাশীতে—যেখানে ভিক্ষাবৃত্তি একমাত্র সম্বল। যাঁদের অল্পবিস্তর অর্থ আছে, তাঁরা জীবনের শেষ পর্যায় বৃদ্ধাশ্রমে অতিবাহিত করেন। চোখে জল নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেন।

বার্ধক্যকালীন সমস্যা আজ পৃথিবী জুড়ে। ১৯৪৮ সালে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে আন্তর্জাতিক ভাবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই অসহায়তা দূর করার জন্য আলোচনা আরম্ভ হয়। বারবার আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ বয়স্ক মানুষদের অধিকার সংক্রান্ত ১৮ দফা সনদ ঘোষণা করেন। প্রত্যেক দেশকে এই সনদ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানানো হয়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ১ অক্টোবর তারিখটিকে ‘বিশ্ব বয়স্ক দিবস’ ঘোষণা করেছে ও ১৯৯৯ বছরটিকে ‘বয়স্ক নাগরিক বৎসর’ হিসেবে পালনের নির্দেশ দিয়েছে।

ভারতের সংবিধানে বয়স্ক নাগরিকদের জীবনযাপন নিশ্চিন্ত করার বিষয়ে এবং তাঁদের ন্যূনতম সুযোগসুবিধা পাওয়ার অধিকার নিয়ে নানা কথা বলা হয়েছে। ভারতের বয়স্ক নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বিষয়টি আলোচনার সময়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে, বেঁচে থাকার অধিকার মানে কেবল মাত্র পশুর জীবন অতিবাহিত করা নয়। বেঁচে থাকার অধিকার মানে সম্পূর্ণ মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার।

এই মুহূর্তে ভারতের জনসংখ্যার ৮.৬ শতাংশ নাগরিকের বয়স ৬০ বছরের বেশি। তার মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই অপেক্ষাকৃত বেশি। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের বার্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেও ভারতের সংবিধানে ঘোষিত নির্দেশাত্মক নীতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে ভারতে বয়স্ক নাগরিক ও পিতামাতাদের দেখার জন্য একটি আইন প্রণীত হয়েছে। এই আইন ‘দ্য মেনটেন্যান্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজেনস অ্যাক্ট, ২০০৭’ নামে পরিচিত।

ওই আইনে সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের মর্যাদা-সহ বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন দফতর (মিনিস্ট্রি অব সোশ্যাল জাস্টিস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট) ও প্রত্যেক রাজ্যে সামাজিক সুরক্ষা কার্যকর করার জন্য বেশ কিছু দফতর রয়েছে। তাদের ২০০৭ সালের আইনটিকে রাজ্যস্তরে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আইনের কয়েকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল—

১) কোনও বয়স্ক নাগরিক আক্রান্ত হলে মহকুমাশাসকের কাছে তাঁর দুর্দশার কথা জানাতে পারবেন। সেই বয়স্ক নাগরিক নিজে না পারলেও যে কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ব্যক্তি ওই বয়স্ক নাগরিকের তরফে মহকুমাশাসকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন।

২) প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিককে দেখাশোনার জন্য ও তাঁর পরিচর্যার জন্য তাঁর সন্তান বা আত্মীয়েরা বাধ্য। অন্যথায় প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে, যাতে বয়স্ক নাগরিকেরা

সুস্থ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপন করতে পারেন।

৩) রাজ্য সরকারকে প্রত্যেক জেলায় কমপক্ষে ১৫০টি শয্যাবিশিষ্ট একটি বৃদ্ধাশ্রম স্থাপন করতে হবে। এই বৃদ্ধাশ্রমে প্রান্তিক পরিবারের বয়স্ক মানুষেরা শেষ জীবন অতিবাহিত করতে পারবেন।

৪) বৃদ্ধাশ্রম কী ভাবে চলবে, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকার একটি রূপরেখা তৈরি করবে। এই রূপরেখায় বয়স্ক নাগরিকদের মর্যাদাপূর্ণ ভাবে বেঁচে থাকার সমস্ত রসদ উল্লেখ করা থাকবে। কেবল মাত্র রূপরেখা তৈরি নয়, রাজ্য সরকারকে রূপরেখা কার্যকর করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, তথ্য জানার অধিকারের ভিত্তিতে রাজ্য সরকার লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এই মুহূর্তে বৃদ্ধাশ্রমগুলির পরিচালনা সংক্রান্ত কোনও রূপরেখা রাজ্য সরকার তৈরি করেনি। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম সরকারি নজরদারির বাইরে থাকবে কেন? এই প্রশ্ন আজ পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বয়স্ক নাগরিকের।

পশ্চিমবঙ্গের বুকে যত্রতত্র বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্ক নাগরিকেরা কী ভাবে বেঁচে আছেন, কেউ জানে না। অনেকভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাঁরা নিঃসঙ্গ গ্লানিময় জীবন অতিবাহিত করছেন এবং প্রতীক্ষায় আছেন, কবে মৃত্যু এসে তাঁদের নিষ্কৃতি দেবে। কিন্তু এই অবস্থা কখনওই শেষ কথা হতে পারে না।

তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেক জায়গায় প্রবীণ নাগরিকরাও সচেতন ও সংগঠিত হচ্ছেন তাঁদের ‘মর্যাদাপূর্ণ বেঁচে থাকার অধিকার’-কে কার্যকর করার জন্য। কেউ কেউ বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হচ্ছেন বার্ধক্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে।

চন্দননগরের বুকে গড়ে উঠেছে ‘অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কল্যাণ সমিতি’, ‘প্রবীণ নাগরিক অধিকার রক্ষা মঞ্চ’ ও ‘প্রবীণ নাগরিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র’। এই সংস্থাগুলির মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছে প্রবীণ নাগরিকদের মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার লড়াই। সংস্থার পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বাস্থ্য মামলা করা হয়েছে প্রবীণ নাগরিকদের অবসরকালীন পেনশন বৃদ্ধি করার জন্য ও জেলায় জেলায় বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার জন্য।

জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও প্রবীণ নাগরিকেরা লড়াই করে যাচ্ছেন। প্রবীণদের সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ক্রমাগত বাড়ছে। তাঁদের জন্য আইন থাকলেও তা অনেকক্ষেত্রেই কার্যকর হচ্ছে না। তবুও বেঁচে থাকে আশা। সেই আশার উপরে নির্ভর করেই প্রবীণদের লড়াই অব্যাহত আছে।

লেখক পরিবেশবিদ ও সমাজকর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Older Persons Legal Rights
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy