চাকরি নেই বলে ভিন রাজ্যের প্রার্থীকে কাজ না দেওয়ার অধ্যাদেশ অগণতান্ত্রিক। ফাইল চিত্র।
বাজারের হাল যত খারাপ হয় ততই নেতারা ভোটের তাগিদে জনমোহিনী নীতির দিকে ঝোঁকেন। আর ততই বাজারের সমস্যা বাড়তে থাকে। আর্থিক হাল নিয়ে আলোচকরা তাই বলেন, ‘দেশের হাল বুঝতে চাইলে প্রথমেই দেখে নাও বাজারের সংরক্ষণের চরিত্র।’ যেমন, কাজের অধিকারকে সংরক্ষণ করা। আর এই বক্তব্যকে সত্যি প্রমাণ করেই দেশের আর্থিক অবস্থা যত খারাপ হচ্ছে, ততই বাড়ছে রাজ্যে রাজ্যে স্থানীয়দের জন্য কাজ সংরক্ষণের প্রবণতা। যেমন মধ্যপ্রদেশ। তা হলে কি আমরা এ বার ‘এক দেশ’ এই ধারণাকে কাগজেকলমে রেখে, কর্মক্ষেত্রে দেশ বিভাজনের পথে হাঁটতে শুরু করলাম?
এ রকম নয় যে— সব যুক্তিতেই সংরক্ষণের কোনও সমর্থন নেই। গণতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থাতেও সংরক্ষণের একটা জায়গা আছে বইকি। এবং তা আছে সবার অধিকারকে সমান মাপে ধরতেই। যেমন, যদি দেখা যায় জাতপাতের কারণে কোনও বিশেষ শ্রেণির মানুষ পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বা চাকরির ক্ষেত্রে সমানাধিকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত, তা হলে সংরক্ষণের দায় রাষ্ট্রের ঘাড়ে গিয়েই পড়ে। এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বাজারে চাকরি নেই বলে ভিন রাজ্যের কর্মপ্রার্থীকে কাজ না দেওয়ার অধ্যাদেশ শুধু অগণতান্ত্রিক তাই নয়, বাজার বিরোধীও বটে।
বাজারের যুক্তি খতিয়ে দেখার আগে, আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে এই জাতীয় সংরক্ষণ নিয়ে কী বলা আছে তা এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক। সংবিধানের ধারা ১৬(৩) বলছে— কাজের বাজারে রাজ্যের সংরক্ষণের অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকার সে পেতে পারে কেন্দ্রের করা আইন মেনে। সংসদ যদি আইন করে বলে কোনও রাজ্য তার অধিবাসীদের জন্য বিশেষ সংরক্ষণ করতে পারে তা হলেই সেই রাজ্যটি এই পথে পা বাড়াতে পারে।
P
১৯৮৪ সালে শীর্ষ আদালত ডক্টর প্রদীপ জৈন বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় বলেছিল, এই ধরনের সংরক্ষণ অসাংবিধানিক। কিন্তু বিচারের রায়ে এর উল্লেখ ছিল না, কারণ মামলার মূল বিষয়টা ছিল অন্য। ২০০২ সালে শীর্ষ আদালত রাজস্থানের স্কুলে স্থানীয়দের কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেয়। রাজস্থান সরকার, যে জেলার স্কুল সেই জেলার শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। আর সেই মামলাতেই এই ধরণের সংরক্ষণকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেয় শীর্ষ আদালত।
আরও পড়ুন: সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর চেয়ারম্যান হলেন অভীক সরকার
এর পর ২০১৯ সালেও ইলাহাবাদ হাইকোর্ট উত্তরপ্রদেশে ইউপিএসএসএসসি-র একই ধরণের সংরক্ষণের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেয়। রাজ্যবাসী মহিলাদের জন্য চাকরি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় তা অসাংবিধানিক বলে। পাব্লিক এমপ্লয়মেন্ট (রিকোয়ারমেন্ট অ্যাজ টু রেসিডেন্স) আইনেও কিন্তু এই জাতীয় সংরক্ষণকে বেআইনি ঘোষণা করা আছে।
মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি, যারা এই রাস্তায় সাম্প্রতিক কালে পা বাড়িয়েছে বা বাড়াতে চাইছে, তারা কতটা সাংবিধানিক রাস্তায় হাঁটছে তা বিচার করার জন্য রয়েছে আদালত। কিন্তু রাজ্যগুলি যদি কাজের বাজারে অন্য রাজ্যের কর্মপ্রার্থীর ঢোকার পথে আগল তুলতে থাকে তা কিন্তু বাজারকে শুধু ভাগই করবে না, তৈরি করবে এক অদক্ষ অর্থনীতি। যুক্তিটা বোঝা যাক।
ধরা যাক আপনি একটা যন্ত্র কিনতে চান। আপনি যে রাজ্যে বাস করেন, সে রাজ্যেও কিছু সংস্থা আছে যারা যন্ত্রটা তৈরি করে। কিন্তু সব থেকে ভালটি তৈরি হয় ভিন রাজ্যে। এ বার আপনার রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, রাজ্যে যে যে সংস্থা এই যন্ত্র তৈরি করে তাদের কাছ থেকেই আপনাকে এই যন্ত্র কিনতে হবে, অন্যথায় আপনাকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত জলাঞ্জলি দিতে হবে। এ বার আপনাকে হয় আপনার রাজ্যের যন্ত্র কিনে অদক্ষ উৎপাদনের রাস্তায় হাঁটতে হবে, না হয় বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। আপনি যদি বিনিয়োগ করেন, তা হলে আপনার তৈরি পণ্য গুণমানে পিছিয়ে থাকবে। আপনাকে তখন রাজ্যের হাতেপায়ে ধরতে হবে যাতে যে পণ্য আপনি তৈরি করেন তার থেকে গুণমানে ভাল পণ্য ভিন রাজ্য থেকে আসতে না পারে। আর এই যুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে গেলে গোটা রাজ্যের বাজারেই ক্রেতাদের নিম্ন গুণমানের পণ্য নিয়েই খুশি থাকতে হবে। তৈরি হবে এক অদক্ষ বাজার। ঠিক যেমনটি হয়েছিল আমাদের লাইসেন্স রাজের জামানায়।
এ বার এই যুক্তিকেই নিয়ে আসুন কাজের বাজারে। আজ যদি ব্যবসার প্রয়োজনে বিশেষ দক্ষতার কর্মী প্রয়োজন হয়, আর রাজ্য সরকার আপনাকে বলে রাজ্যের লোককেই আপনাকে কাজ দিতে হবে, তা হলে কী করবেন আপনি? আপনার ক্ষমতার মধ্যে তো আপনি চাইবেন সেই কর্মীকেই যে ওই মাইনেতে সব থেকে বেশি দক্ষ। আর এটা তো হতেই পারে যে আপনার পাশের রাজ্যেই একজন আছে যে আপনার রাজ্যে যাঁরা এই কাজটা করতে পারেন, তাঁদের সবার থেকে বেশি দক্ষ এবং আপনার সঙ্গে কাজ করতে রাজি! অথচ এই আইন আপনার পথে কাঁটা।
অদক্ষ শ্রমিক মানে কিন্তু অদক্ষ উৎপাদন ব্যবস্থা। আর একদিকে প্রতিযোগিতার কথা বলে অন্যদিকে যদি রাজ্যগুলি এই ধরনের সংরক্ষণের পথে হাঁটে? তা হলে সংস্থাগুলিকে যেমন কাজ চালাতে হবে তুলনামূলকভাবে অদক্ষ কর্মী দিয়ে, ঠিক তেমনই দক্ষ শ্রমিককে তার দক্ষতার মূল্য না পেয়ে পেট চালাতেই বেছে নিতে হবে তার জন্য অযোগ্য কোনও কাজ।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ ডিসলাইক পড়ল প্রায় ৬ গুণ, নিট-জি প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ নেটাগরিকদের
আজ কিন্তু বেঙ্গালুরু আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র হিসাবে তৈরি হতে পেরেছে কারণ সে কর্নাটক থেকে কর্মী না খুঁজে, দেশের বাজার থেকে দক্ষতা কিনেছে। আজ যদি কোনও রাজ্য সিদ্ধান্ত নেয় যে মধ্যপ্রদেশের কাউকে সেই রাজ্যের কাজের বাজারে ঢুকতে দেবে না, তা হলে! তা হলে তো সে রাজ্যের দক্ষতাও তার যথাযোগ্য বাজার খুঁজে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে! তৈরি হবে এক অদক্ষ অর্থনীতি। সেই লাইসেন্স রাজের ভারতের মতো। এতে কিন্তু ক্ষতি গোটা দেশেরই। তা জেনেও এই জাতীয় সংরক্ষণের রাস্তায় হাঁটছি কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy