Advertisement
E-Paper

আইসোলেশনেও আফসোস নেই, শতাধিক প্রাণ বাঁচিয়ে বলছেন মান্নান-আফজলরা

কেন্দ্র থেকে রাজ্য, আহত যাত্রী থেকে চিকিৎসক, আমলা থেকে আমজনতা— সবাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছেন গ্রামবাসীদের।

দুর্ঘটনার পর এ ভাবেই উদ্ধারে হাত লাগিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুক্রবার রাতে কোঝিকোড়ে। ছবি: এএফপি

দুর্ঘটনার পর এ ভাবেই উদ্ধারে হাত লাগিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুক্রবার রাতে কোঝিকোড়ে। ছবি: এএফপি

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২০ ১৭:০৯
Share
Save

কারিপুর, কোনদোত্তি গ্রামের ঘরে ঘরে এখন হোম আইসোলেশন। করোনা আক্রান্তের সংখ্যাবৃদ্ধি নয়, বিমান দুর্ঘটনার জন্য। কেরলের কোঝিকোড় বিমানবন্দর লাগোয়া গ্রামগুলির প্রায় সব বাড়ি থেকেই লোকজন শুক্রবার রাতে ছুটে গিয়েছিলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানের যাত্রীদের উদ্ধার করতে। কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে কে শৈলজা ঘোষণা করেছেন, ওই দিন যাঁরাই উদ্ধারে হাত লাগিয়েছিলেন, সবাইকে ১৪ দিনের হোম কোয়রান্টিন থাকতে হবে। তাতে অবশ্য আফসোস-অনুতাপ নেই কারও। বরং এত মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তৃপ্তি হারিয়ে দিয়েছে নিভৃতবাসের সাময়িক সমস্যা।

কেন্দ্র থেকে রাজ্য, আহত যাত্রী থেকে হাসপাতালের চিকিৎসক, এয়ার ইন্ডিয়ার স্টাফ থেকে বিমানবন্দরের কর্মী, আমলা থেকে আমজনতা— সবাই এক বাক্যে স্বীকার করছেন, দুর্ঘটনার পর স্থানীয়রা এ ভাবে সাহায্য না করলে কোঝিকোড় বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হতে পারতে অনেক বেশি। কিছু দিন আগেও যে কেরলে আনারসের মধ্যে বাজি ভরে অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে খাওয়ানো এবং সেই হাতির মৃত্যু ঘিরে রাজ্যবাসীর মুখ পুড়েছিল, নিন্দায় সরব হয়েছিল গোটা দেশ— সেই কেরলকেই এখন ঈশ্বরের দূতের মর্যাদায় প্রশংসা করছেন নেটাগরিকরা।

কী ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সে দিন স্থানীয়রা? নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা অনেকে নিজেই শেয়ার করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন। অনেকে আবার নিজে উদ্ধারে যেতে না পারলেও যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের কথা তুলে ধরেছেন। ‘বন্দে ভারত মিশনে’ দুবাই থেকে কোঝিকোড়ে আসছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ অবতরণের সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে গিয়ে খাদে পড়ে বিমানটি। ওই ঘটনার পরে কেউ টিভিতে খবর দেখে, কেউ আবার বিকট শব্দ শুনে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। বিমানবন্দরের উদ্ধারকর্মী ও প্রশাসনিক কর্তাদের পাশাপাশি তাঁরাও হাত লাগান উদ্ধার কাজে। বিমানের ভিতরে আটকে পড়া যাত্রীদের বের করা থেকে শুরু করে, হাসপাতালে পৌঁছনো কিংবা রক্ত দেওয়া— সবেতেই এগিয়ে এসেছেন কারিপুর-সহ আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন: লক্ষ্য আত্মনির্ভরতা, ১০১ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা কেন্দ্রের

‘‘প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা ভয়ঙ্কর একটা শব্দ শুনতে পেলাম। তাকাতেই দেখি, সীমানা প্রাচীরের বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তায় আছড়ে পড়ল বিমানটি।’’— বলছিলেন কারিপুরের মহম্মদ সহাল। চোখে-মুখে তখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। সহাল বলে চলেন, ‘‘প্রথমে তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না। কিন্তু তার পরেই সাহায্যের জন্য আর্ত চিৎকার কানে আসছিল। চারদিকে একটা ধোঁয়াশা মতো অবস্থা। জ্বালানির গন্ধ। দুর্ঘটনার পর প্রথম যাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই সহাল।

দুর্ঘটনার আগে প্রায় দু’দিন ধরে টানা ভারী বর্ষণ চলছে কেরল জুড়ে। ধস, জলমগ্ন হয়ে এমনতিতেই জনজীবন কার্যত বিপর্যস্ত। ২২ বছরের কলেজপড়ুয়া মান্নানও (নিজেই নাম প্রকাশ করতে চাননি বলে পরিবর্তিত) তাই ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই ধস নেমেছে। ‘‘প্রথমে যখন তীব্র শব্দ শুনলাম, ভেবেছিলাম বিরাট ধস নেমেছে।’’— বলেন মান্নান। বিমানবন্দরের লাগোয়া গ্রামে থাকায় সেখানকার ইতিহাস-ভূগোল প্রায় হাতের তালুর মতো চেনেন মান্নান। তিনি বলে চলেন, ‘‘কোঝিকোড়ের টেবলটপ বিমানবন্দরের রানওয়ের শেষে একটা পাহাড়ের ওপারেই আমরা থাকি। রাত ৮টা নাগাদ যখন জানতে পারলাম বিমান দুর্ঘটনার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম বিমানবন্দরে।’’

পড়ে রয়েছে সেই বিমানের ধ্বংসাবশেষ। চলছে পর্যবেক্ষণ। ছবি: রয়টার্স

তবে যখন তাঁরা বিমানবন্দরে ঢুকেছিলেন, উদ্ধারকাজ শেষের পথে। তবু অনেককে তখনও হাসপাতালে পাঠানো বাকি ছিল। তাঁরা সেই ব্যবস্থা করেছেন। মান্নান বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ১৪ দিনের জন্য কোয়রান্টিনে থাকতে। আমি শুধু এটা ভেবেই আনন্দিত যে, অনেককে তড়িঘড়ি উদ্ধার করতে পেরেছি। কারণ যে কোনও সময় বিস্ফোরণের সম্ভাবনা ছিল। সময়মতো সব কিছু হওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে।’’

আরও পড়ুন: সেফ হাউসে আগুন, বিজয়ওয়াড়ায় মৃত ৯ করোনা রোগী

পি আফজল নামে অন্য এক উদ্ধারকারী বলেন, ‘‘প্রথমে আমরা অ্যাম্বুল্যান্সের জন্যে অপেক্ষা করিনি। ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ট্যাক্সিতেও আহত যাত্রীদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। পুলিশকে যান নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করেছেন আমাদের অনেকে।’’ উদ্ধারের সময়ের ঘটনার বর্ণনা দিলেন অন্য এক স্থানীয় বাসিন্দা, ‘‘ছোট শিশুরা সিটের নীচে পডে় আছে। সে দৃশ্য ভয়ানক। আমরা যখন পৌঁছলাম, বেশ কয়েকজনকে বিমান থেকে নামানো হয়েছে। তাঁদের অনেকই গুরুতর আহত। কারও পা ভেঙেছে, কারও হাত। আহতদের রক্তে আমার হাত আর শার্ট পুরো রক্তে ভিজে গিয়েছে।’’

এগুলি দু’-চারটি উদাহরণ মাত্র। কারিপুর- কোনদোত্তি গ্রামে গেলে এই রকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী প্রায় প্রতি ঘরে। জাতপাত, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে ছুটে এসেছিলেন যে যার মতো করে। কেউ চেনা নয়, কেউ কারও আত্মীয় পরিজন নয়। মানুষ বিপদে পড়েছেন এবং তাঁদের সাহায্য করতে হবে, এটাই ছিল তাঁদের মূলমন্ত্র। ভুলে গিয়েছিলেন বাকি সব কিছু।

শুক্রবার রাতে এ ভাবেই রানওয়েতে নামার চেষ্টা করেছিল দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিও (নীচে)। কিন্তু ঘটে যায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ছবি: এএফপি

বেশিরভাগ দুর্ঘটনাতেই বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা প্রশাসনের আগে ঝাঁপিয়ে পড়েন এলাকাবাসী। কোঝিকোড়ও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু বিমানবন্দর লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দারা যে ভাবে উদ্ধারে হাত লাগিয়েছেন, তা অন্য মাত্রা পেয়েছে একাধিক কারণে। প্রথমত দু’দিন ধরে টানা বৃষ্টির জেরে কার্যত ঘরবন্দি ছিল গোটা কেরল। দুর্ঘটনার সময়েও প্রবল ভারী বৃষ্টি হচ্ছিল কোঝিকোড়ে। ধস, বন্যায় রাজ্য মারা গিয়েছেন বেশ কয়েকজন। অন্য দিকে ছিল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়। আবার বিমানের যাত্রীরাও আসছেন বিদেশ থেকে। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা ছিল বেশি। কিন্তু সে সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে বৃষ্টি মাথায় করে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা। কারও মুখে মাস্ক আছে কি নেই, দেখেননি সে সব কোনও কিছুই। বরং নিজেদের নিকটজনের মতো করে, সন্তানের মতো ভেবে উদ্ধারে হাত লাগিয়েছেন, পরিচয় জানতে সাহায্য করেছেন প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন আহত যাত্রীদের জন্য রক্ত দিতে।

অনেক ক্ষেত্রে আবার এই ধরনের দুর্ঘটনায় উদ্ধারের পাশাপাশি সুযোগসন্ধানী এক দলকেও ময়দানে নামতে দেখা যায়। বিপদের সুযোগ নিয়ে যাত্রীদের মালপত্র, টাকাপয়সা বা মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও থাকে। কিন্তু কোঝিকোড়ের ঘটনায় তেমন কোনও অভিযোগ নেই।

কোঝিকোড়ের বেবি মেমোরিয়াল হাসপাতালে শিশু চিকিৎসক অজয় যেমন বলেছেন, ছয় শিশুর বয়স ২ থেকে ১১-র মধ্যে। তিন জনকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। এই তথ্য দিয়েই তিনি বলেন, ‘‘এলাকাবাসীকে কুর্নিশ। এই শিশুদের ওঁরা নিজেদের সন্তানের মতো দেখেছে। শিশুদের কেউ নাম-পরিচয় বলতে পারছিল না। পাসপোর্টেরও খোঁজ নেই। ফলে আমাদের কাছে ওই শিশুদের পরিচয় খুঁজে বের করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এলাকাবাসীরাই লেগে পড়েন সেই কাজে। বহু মানুষ ওই শিশুদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। পরিচিতদের জানিয়েছেন। তার তিন-চার ঘণ্টার মধ্যেই আমরা সবার পরিচয় জেনে যাই।’’

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে স্থানীয় প্রশাসন সবার মুখেই গ্রামবাসীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। গ্রামবাসীদের সাহায্যের কথা শোনা গিয়ে কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরীর মুখেও। মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নের মতে, সাধারণ মানুষ ও স্থানীয় প্রশাসন যে ভাবে এই বিপদের সময় এগিয়ে এসেছেন, তাতে এত বড় বিপর্যয়েও জীবনহানি কম হয়েছে। মালাপ্পুরমের জেলাশাসক কে গোপালকৃষ্ণনও বলেছএন, ‘‘এ যেন মিরাক্যল। আমরা ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানি কমাতে পেরেছি। এলাকাবাসীই প্রথম ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁরাই প্রকৃত হিরো। ওঁরাই অন্যদের বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানে ঢুকেছিলেন। আমাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, বেশি মানুষকে বাঁচানো। ওঁরাই দেবদূতের মতো সেই কাজটা করেছেন।’’

Kozhikode Kozhikode Plane Crash Air India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।