রাজ-দরবারে প্রদ্যোৎ কিশোর। ছবি: বাপী রায়চৌধুরী।
গ্রামের নাম লাল সিংহ মুড়া। মঞ্চ ঘিরে জনজাতি জনতার মুঠো মুঠো লোক। মঞ্চ থেকে কুর্তা-পাজামা শোভিত শুভ্র চেহারা আবেগমথিত গলায় পর পর কয়েক জনের নাম করে বলছে, ‘‘এদের সকলকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। আমার সঙ্গে থাকবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু প্রার্থী তালিকায় নাম নেই, দেখা মাত্রই এরা ছেড়ে চলে গিয়েছে! আশা করব, আপনারা সঙ্গে থাকবেন। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে আর আপনাদের কাছে ভোট চাইতে আসব না। আপনাদের সমর্থন চেয়ে গেলাম।’’
ভোটের প্রচারের শেষ লগ্নে তিপ্রা মথা-র সর্বোচ্চ নেতার এমন ঘোষণায় ত্রিপুরা জুড়ে আলোড়ন! ‘মহারাজ’ তা হলে রাজনৈতিক সন্ন্যাসে চললেন? ভোটের ফলাফল না দেখেই ঘোষণা হয়ে গেল?
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের দো’তলায় ঝাড়বাতির নীচে আড্ডা দিতে বসে পরের সন্ধ্যায় তিনিই আবার বলছেন, ‘‘আমি তো রাজনীতিক নই! পরের লোকসভা ভোটের সময়ে কী হবে, এত কিছু হিসেব করিনি। জনজাতিদের দাবি নিয়ে লড়াই করছি, তাঁদের কাছে সব রকম ভাবে সহায়তা চাইছি।’’
বেহিসেবি আবেগ এবং আশাবাদ নিয়ে এ বারের ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন যিনি, তাঁর পোশাকি নাম প্রদ্যোৎ কিশোর দেববর্মা। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের বর্তমান কুমার। বাবা এবং মা দু’জনেই কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন। প্রদ্যোৎ নিজেও ছিলেন কংগ্রেসে। রাহুল গান্ধী ও প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার ব্যক্তিগত বন্ধু আজও। রাজাসুলভ আভিজাত্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে জনজাতি তালুকের ধুলো মাখছেন এখন। ককবরক ভাষায় রাজা এখন হয়েছেন জনজাতিদের আদরের ‘বুবাগ্রা’। নতুন দল গড়েছেন তিপ্রা মথা। রাজ্যে গত স্বশাসিত জেলা পরিষদের (এডিসি) নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেয়ে যারা এ বার টানাপড়েনের কেন্দ্রে। বিজেপির অমিত শাহ, সিপিএমের জিতেন্দ্র চৌধুরী থেকে কংগ্রেসের সুদীপ রায় বর্মণ— মহারাজের সহায়তা প্রার্থীদের তালিকায় কে নেই!
কেন এত দাপট এখন ‘বুবাগ্রা’র? ত্রিপুরার জনসংখ্যার প্রায় ৩২% জনজাতি। সব মিলিয়ে ১৯টি গোষ্ঠী। মোট ৬০ আসনের বিধানসভায় তাঁদের জন্য সংরক্ষিত আসন ২০টি, তার বাইরেও এক ডজ়নের বেশি আসনে জনজাতি ভোটের প্রভাব আছে। পাঁচ বছর আগে আইপিএফটি-কে সঙ্গী করে ওই ২০ আসনের মধ্যে ১৮টি জিতে বাজিমাত করেছিল বিজেপি। তার পরে মোহভঙ্গের জেরে জনজাতি মনে ভাঙন ধরে, শুরু হয় বিজেপি-আইপিএফটি’র সঙ্গে বাকিদের মল্লযুদ্ধ। বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দিতে সুবিধা হবে ভেবেই সিপিএম এবং কংগ্রেসের জনজাতি কর্মীদের বড় অংশ চলে আসেন প্রদ্যোতের মথা-র পতাকার নীচে। তারই সূত্র ধরে এডিসি ভোটে মথা-র সাফল্য এবং ‘বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ডে’র সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে তাদের আন্দোলনে শান। রাজনৈতিক শিবিরের বড় অংশের মতে, জনজাতি ভোট এ বারও ত্রিপুরার ফলের দিগ্নির্দেশ দেবে এবং সেখানেই ‘রাজা’ গড়ার খেলায় নামবেন মহারাজ!
খাতায়-কলমে ৪২টি কেন্দ্রে প্রার্থী আছে মথা-র। কিন্তু বেশ কিছু আসনে তারা বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে অলিখিত সমঝোতা করেছে বলে খবর। তাঁর ‘বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ডের’ দাবির সমর্থনে লিখিত আশ্বাস কোনও দল দেয়নি, তাই কারও সঙ্গে আনুষ্ঠানিক জোট করেননি প্রদ্যোৎ। কিন্তু এমন কৌশল নিয়েছেন যে, ভোটের পরে সরকার গড়ার জন্য সংখ্যা দরকার হলেই যাতে চাপের খেলায় যত দূর সম্ভব আশ্বাস আদায় করে নেওয়া যায়!
নিজে তো ভোটে দাঁড়াননি, গণতান্ত্রিক পথে ‘রাজা’ হওয়ার শখও নেই। তাঁর পছন্দ, হয় নতুন সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন নতুবা বিরোধী আসনে দলকে বসানো। কিন্তু ভোটের পরে কেন্দ্রের শাসক বিজেপির প্রভাব ও অর্থের কাছে যদি সব কৌশল হেরে যায়? প্রদ্যোতের দাবি, ‘‘ভোটের পরে কী হবে, জানি না। তবে আমার রক্তে বিজেপি নেই, আমি জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া (পারিবারিক সম্পর্কে প্রদ্যোতের তুতো ভাই) হতে পারব না! আমাদের যাঁরা বিধায়ক হবেন, তাঁরাও বিক্রি হবেন না!’’
রাজ-বাক্যের দাম থাকবে ভোটের পরেও, এই আশাতেই আছে সিপিএম এবং কংগ্রেস। আর বিজেপি ভাবছে, রাজার গুমোর ভাঙবে কবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy