Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

কিডনির বিকিকিনি খুল্লমখুল্লা ডট কম

বহু দরাদরি করেও কিছুতেই একটা কিডনির জন্য সত্তর লাখের বেশি দিতে রাজি হলেন না তিনি। অপারেশনের আগে নগদ ৩৫ লাখ হাতে মিলবে। কিডনি দেওয়ার পরে আরও ৩৫। হাসপাতালে থাকতে হবে সব মিলিয়ে তিন দিন।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০৮:৫২
Share: Save:

বহু দরাদরি করেও কিছুতেই একটা কিডনির জন্য সত্তর লাখের বেশি দিতে রাজি হলেন না তিনি। অপারেশনের আগে নগদ ৩৫ লাখ হাতে মিলবে। কিডনি দেওয়ার পরে আরও ৩৫। হাসপাতালে থাকতে হবে সব মিলিয়ে তিন দিন। সেখানে কোনও খরচ লাগবে না। আসা-যাওয়ার খরচও পাওয়া যাবে।

এই ‘তিনি’টি হলেন জনৈক ডাক্তার রবার্ট।

ইন্টারনেটে এই রবার্টের নামেই দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞাপন। তাঁকেই ধরা হয়েছিল টেলিফোনে। জানানো হল, টাকাপয়সা নিয়ে কোনও চুক্তিপত্র তো সই হচ্ছে না! কথার খেলাপ হবে না তো? ভিনদেশি উচ্চারণের ইংরেজিতে তাঁর আশ্বাস, ‘‘দিল্লি চলে এলেই আপনার সব সংশয় কেটে যাবে।’’ আর যদি শরীরে কোনও অসুবিধা হয়? জবাব মিলল, ‘‘কিচ্ছু হবে না।’’

ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে ‘ডাক্তার রবার্ট’ অতি পরিচিত নাম। কিডনি বিক্রির জন্য কোথায় কোথায় যোগাযোগ করতে হবে জানিয়ে ফোন নম্বরের ছড়াছড়ি। বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে দিল্লি অ্যাপোলো হাসপাতালের নামও রয়েছে বিজ্ঞাপনে। বলা হয়েছে, অস্ত্রোপচার হবে ওই হাসপাতালেই। দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ কি বিষয়টা জানেন? সেখানকার সেলস বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার রাজকুমার রায়না এবং জনসংযোগ বিভাগের মুখপাত্র করণ ঠাকুর জানালেন ‘ডাক্তার রবার্টে’র নামের সঙ্গে পরিচিত তাঁরা। তাঁদের কথায়, ‘‘এদের জন্য নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি আমরা। নাম খারাপ হচ্ছে আমাদের হাসপাতালের। কত বার সাইবার ক্রাইম বিভাগকে অভিযোগ জানিয়েছি। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছি। কিন্তু আমাদের নাম করে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধই হচ্ছে না।’’

যে কিডনি পাচার চক্রের সন্ধানে দিল্লি পুলিশ এখন হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছে, তার অন্যতম সূত্র কিন্তু দিল্লির এই অ্যাপোলো হাসপাতাল। নির্দিষ্ট সূত্র মারফত অভিযোগ পেয়ে সেখানে ভর্তি এক মহিলা ও তাঁর স্বামীকে প্রথমে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাঁদেরকে জেরা করেই জানা যায়, কিডনি পাচার চক্রের দালালদের হাত ধরেই এক গ্রহীতার আত্মীয়ের পরিচয়ে ওই মহিলা কিডনি-দাত্রী হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন। অ্যাপোলো-র দুই চিকিৎসকের দুই সহকারীকেও ওই সূত্রে গ্রেফতার করা হয়।

কিন্তু হাসপাতালের কর্মীরাই যদি গ্রেফতার হয়, তা হলে আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে ডাক্তার রবার্টকে দুষছেন কেন? কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ‘‘নকল কাগজপত্র তৈরি করে রোগীর আত্মীয় সাজিয়ে এই দাতাদের নিয়ে আসছে দালালেরা। দাবি করছে, ‘মানবিকতার খাতিরে’ কিডনি দান করতে চাইছেন দাতা। আমরা তো আর পুলিশ নই যে তাঁদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে সেটা নকল কিনা বুঝব। ফলে আমরা কিডনি প্রতিস্থাপন করে দিচ্ছি।’’ হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে নিয়ে কি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? কর্তৃপক্ষের জবাব, ‘‘তদন্ত শেষ হয়নি, তাই কিছু বলা যাবে না।’’

কিন্তু ঘটনা হল, দিল্লি পুলিশ যতই দেশ জুড়ে অভিযান চালাক না কেন, ইন্টারনেট থেকে কিডনি বিক্রির বিজ্ঞাপন সরেনি। সেখানে যে সব ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, তার মালিকরাও সক্রিয়। ডাক্তার রবার্টের দৃষ্টান্তই তার প্রমাণ। নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করতেই যিনি নাম-ধাম-বয়স-রক্তের গ্রুপ জিজ্ঞাসা করে বলছেন, ‘‘অসুবিধা নেই। দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে চলে আসতে হবে। একটা কিডনির জন্য সত্তর লাখ মিলবে।’’ বাকি যাবতীয় তথ্য পাঠানোর জন্য ই-মেল আইডি চাইলেন। কিছু ক্ষণের মধ্যে মেল চলেও এল। তাতে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে বিশেষ নোট লেখা— ‘কিডনির জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি এক লক্ষ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দিতে পারি।’

শুধু ডাক্তার রবার্ট নন। ইন্টারনেটে তাঁর মতো ক্রেতার ছড়াছড়ি। বিজ্ঞাপনে তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো নানা দেশে তাঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন। ‘রাতারাতি অর্থকষ্ট মিটিয়ে ফেলার জন্য কিডনি বিক্রির বিকল্প হয় না’— এমন কথা লিখে কিডনি বিক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টাও হয়েছে। এই রকমই একটি নম্বরে ফোন করতে এক মহিলা কণ্ঠ ফোন ধরলেন। তিনিও ইংরেজিতে কথা বললেন এবং মেল আইডি চাইলেন। এখানে একটি কিডনির দর অবশ্য ২৫ লাখ বলা হল। কিছুক্ষণের মধ্যে মেল এবং একটি ফর্ম চলে এল। সেই মেল-এ বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালের নাম উল্লেখ করে ‘লুইস মরিস’ নামে এক জন নিজেকে চিকিৎসক বলে দাবি করে জানিয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের চিকিৎসা করেন। এবং কিডনি বিক্রির পক্ষে এটা আদর্শ, নির্ভরযোগ্য জায়গা! খোঁজ নিয়ে অবশ্য জানা গিয়েছে— যে হাসপাতালের নাম দেওয়া হয়েছে, বেঙ্গালুরুতে সেই নামে আদৌ কোনও হাসপাতালই নেই।

ইন্টারনেটে পাওয়া এই রকম আর একটি নম্বরে ফোন করলে মরাঠি টানে হিন্দি বলা এক ব্যক্তি নাম-ধাম-বয়স-রক্তের গ্রুপ জেনে নিলেন। কিডনি ছাড়া অন্য কোনও অঙ্গ বিক্রি করতে আগ্রহী কিনা সেটাও জিজ্ঞাসা করলেন। তার পর বললেন, ‘‘মুম্বই আসতে হবে। এখানে ডেভিড গ্রে আছেন। তিনি সব বুঝে নেবেন। একটা কিডনির জন্য ৪ লাখ টাকা দেওয়া হবে।’’ ডেভিড গ্রে কে? উত্তর এল, ‘‘তিনি আমাদের বড়াসাহেব। কিডনি কেনার ব্যাপারটা উনিই দেখেন। বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে ডিল করেন। আপনার ফোন নম্বর দিয়ে রাখুন, উনি যোগাযোগ করে নেবেন।’’

ইন্টারনেটে এমন জমাটি ব্যবসা চলছে, সেটা কি গোয়েন্দারা জানেন না? রাজ্যে সিআইডি-র এক উচ্চপদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কেউ কোনও অভিযোগ আজ পর্যন্ত করেনি। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার কাছ থেকে অভিযোগ এলে তবেই আমরা কিছু করতে পারব।’’ স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘‘ইন্টারনেটে অঙ্গ ব্যবসার বিষয়টা জানতাম না। এখন জানলাম। পুলিশকে নিশ্চয়ই অভিযোগ জানাব।’’ নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার, ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষ, অনুপ কুণ্ডুদের মতো সকলেই অবশ্য মনে করছেন, যত দিন চাহিদা ও জোগানের অসমাঞ্জস্য থাকবে তত দিন কিডনি দালালরাও থাকবে, তাদের বিজ্ঞাপনও চলবে।

তা হলে উপায়?

অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে বেআইনি ব্যবসা তবে কী করে ঠেকানো যাবে? চিকিৎসকদের মতে, ‘ক্যাডাভার ট্রান্সপ্লান্ট’ই এ কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। কী ভাবে? ‘ব্রেন ডেথ’ বা মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়েছে এমন ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ তুলে নিয়ে প্রতিস্থাপনের কাজে লাগানো। এ রাজ্যে একটি ‘ব্রেন ডেথ ডিক্লেয়ার কমিটি’ তৈরিও হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, বিভিন্ন হাসপাতালে কার্যত ব্রেন ডেথ হয়ে যাওয়া রোগীদের উপরে নজর রাখবেন তাঁরা। রোগীর আত্মীয়দের বুঝিয়ে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করবেন এবং রোগীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে প্রতিস্থাপনের কাজে ব্যবহার করার অনুমতি দিতে উৎসাহিত করবেন। কিন্তু চিকিৎসকদের অভিযোগ, কোনও অজানা কারণে এই কমিটি কোনও কাজ করে না। ফলে দালালেরাও হার মানে না।

(সহ প্রতিবেদন: মধুরিমা দত্ত)

অন্য বিষয়গুলি:

kidney buying and selling website kidney
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy