Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ram Mandir Inauguration

বাংলার ‘জয় শ্রীরাম’ নেই খোদ অযোধ্যায়! উচ্চারণে, রামভূমে সে যুদ্ধের স্লোগান নেই, আছে সম্ভাষণের মন্ত্র

অযোধ্যা আসার পথে যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনেছি, সেটা নেই রামভূমে। এখানে সবাই মিঠে সুরে বলেন ‘জয় সিয়ারাম’। কেন এমন ফারাক? কী করে একটা ধর্মীয় ধ্বনি রাজনৈতকি স্লোগান হয়ে উঠল?

অযোধ্যায় সরযূ নদীর ঘাটে আসা ভক্ত।

অযোধ্যায় সরযূ নদীর ঘাটে আসা ভক্ত। —ছবি: পিটিআই।

পিনাকপাণি ঘোষ
অযোধ্যা শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৭
Share: Save:

এখানে রাম ‘রাজা’ নন। রামলালা। ঘরের ছেলে। কিন্তু গোটা দেশে কারও কাছে রাম হলেন রাজা, কারও কাছে পুরুষোত্তম। তাই তাঁর জন্য জয়ধ্বনিতে বাংলা কিংবা অন্যত্র যে ‘তেজ’, তা অযোধ্যায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। নরম হয়ে উচ্চারিত হবে, হচ্ছে ‘জয় সিয়ারাম’। রামভূমের রামের নামে চিৎকার যে নেই, তা নয়। তবে সেটা বহিরাগতদের। স্থানীয়েরা যখন বলেন, তখন সেটা নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার মতো। শোনা যায় ঠিকই। তবে বলেন মনে মনে।

বিমানবন্দরে নিরাপত্তাকর্মী আলতো শব্দে ‘জয় সিয়ারাম’ বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার পরে ট্যাক্সিচালক থেকে হনুমানগড়ি চৌমাথার চা-বিক্রেতা বাবলু সিংহ বা স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীদের মুখে পরিচয়ের শুরুতে এবং শেষে বিদায় জানানোর সময় আলতো উচ্চারণে ‘জয় সিয়ারাম’। এঁদের কাছে রাম যোদ্ধা নন, করুণাময়।

এই এলাকায় নাকি অনেক মুসলমানও ‘সিয়ারাম’ বলেই একে অপরকে সম্বোধন করেন। অযোধ্যায় সকলেই জানেন ধর্মের কথা। ছোট থেকে বড় সকলেই ধর্মজ্ঞানী। ধর্মই এই শহরের বারোমাস্যা। হোটেলের কর্মী বাবুলাল শোনাচ্ছিলেন তাঁর দাদুর কাছে শোনা কাহিনি। বলছিলেন, ‘‘এখানে কোনও বিপদে পড়লেও সকলে ‘জয় সিয়ারাম’ বলেন। দাদু বলতেন, জমিদারের আক্রমণ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই ধ্বনিই সকলকে এককাট্টা করে দিত।’’

কিন্তু সেই ধ্বনি এমন ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হয়ে গেল কী করে? নিরামিষ ধর্মীয় ধ্বনি আমিষ স্লোগান হয়ে ওঠার ইতিহাস রয়েছে। পর্যায়ক্রমও রয়েছে। সবই এই অযোধ্যা এবং রামজন্মভূমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।

অযোধ্যায় রামমন্দিরের সামনে কর্মরত পুলিশ।

অযোধ্যায় রামমন্দিরের সামনে কর্মরত পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থানীয় নেতা জয়রাম বনসল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাম কি পৌরিতে ‘লেজার শো’ দেখতে দেখতে বলছিলেন, ‘‘আমার নামে যেমন রাম রয়েছেন, তেমন অনেকের নামেই আছে। বাবা-মায়েরা আমাদের ডাকার সুযোগেও এক বার রামের নাম নিয়ে নেন।’’ কিন্তু ‘সিয়ারাম’ কী করে বদলে গেল ‘জয় শ্রীরাম’-এ? জয়রামের জবাব, ‘‘অযোধ্যার সঙ্গে বাকি ভারতকে এক করলে হবে না। আমাদের রামলালা কিন্তু সকলের কাছে শ্রীরাম ভগবান। তিনি যুদ্ধে রাক্ষসকুলকে মেরেছেন। রাবণকে পর্যুদস্ত করে সীতা মাকে উদ্ধার করেছেন। তিনি যোদ্ধা। তাই তিনি শ্রীরাম।’’

গড়গড় করে জয়রাম বলতে লাগলেন সেই ১৯৮৮-’৮৯ সালের ঘটনা। ‘‘রামজন্মভূমি আন্দোলন যখন বড় আকার নিল, তার আগে থেকেই চলছিল প্রস্তুতি। টিভিতে তখন রামানন্দ সাগরের রামায়ণ সিরিয়াল চলছে। সেখানে হনুমানজি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিচ্ছেন। গোটা দেশের কাছেই পরিচিত হয়ে যায় ধ্বনিটা। এর পরের কাজ ছিল সেটা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া। রামকে যোদ্ধা হিসাবে চেনানো। লালকৃষ্ণ আডবাণী রামরথ নিয়ে বার হওয়ার আগেই শহরে-গ্রামে ঘুরে ঘুরে সমস্ত বাড়ির দরজায় ‘জয় শ্রীরাম’ লেখা স্টিকার লাগানো শুরু হয়। রামশিলা পূজন কর্মসূচির সময়ে প্রতিটি ইটে লেখা থাকত স্থানীয় হরফে ‘জয় শ্রীরাম’। সেটা পশ্চিমবঙ্গেও হয়েছে।’’

১৯৯০ সালে যখন গোটা দেশ থেকে করসেবকরা অযোধ্যায় এলেন, তখন সর্বজনীন ধ্বনি হয়ে ওঠে ‘জয় শ্রীরাম’। জয়রামের কথায়, ‘‘অযোধ্যাও তখন ওই ধ্বনি শিখল। তাই রাজনীতির মঞ্চে এখনও ‘জয় শ্রীরাম’ বলা হয়। কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় বাবা-মায়ের থেকে শেখা সুরে ‘জয় সিয়ারাম’ বলি।’’

অযোধ্যাতেও ‘জয় শ্রীরাম’ শেখানোর পর্ব ছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল এবং বিজেপি নেতারা প্রচার করতে শুরু করেন, ‘‘রাম রাম ছোড়ো! জয় শ্রীরাম বোলো!’’ বস্তুত, ‘জয় সিয়ারাম’-এর পাশাপাশি ‘রাম রাম’ কিংবা ‘জয় রামজি কি’ বলারও চল ছিল অযোধ্যা-সহ দেশের অনেক জায়গায়। কিছু কিছু রয়ে গেলেও দীর্ঘ চেষ্টায় ‘এক সুর’ করায় সফল হয় গেরুয়া শিবির। ‘সিয়ারাম’ ধ্বনিতে প্রথমে রয়েছেন সীতা, পরে রাম। কাহিনি অনুযায়ী রাম একজন পত্নীবৎসল রাজা। কিন্তু ধীরে ধীরে দেশ জুড়ে রামসীতার যুগল মূর্তি সরিয়ে শুধু রামের ছবি সামনে আনা হয়। হাতে তাঁর তির-ধনুক। আর ‘জয় শ্রীরাম’ পেয়ে গেল এক যুদ্ধং দেহি ভাব।

অযোধ্যা রামমন্দিরের সামনে সন্ধ্যার দৃশ্য।

অযোধ্যা রামমন্দিরের সামনে সন্ধ্যার দৃশ্য। —ছবি: পিটিআই।

সেই স্লোগানের ফল পেল বিজেপি। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মাত্র দু’টি আসনে জয়ী বিজেপি পাঁচ বছর পরে ১৯৮৯ সালে ৮৫ জন সাংসদ নিয়ে লোকসভায় গেল। দু’বছর কাটতে না কাটতেই ১৯৯১ সালে সাংসদ সংখ্যা ১২০। আর ১৯৯৬ সালে ১৬১টি আসন জিতে প্রথম বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। এর পরের কয়েকটা বছর রামজন্মভূমি আন্দোলন থেকে দূরত্ব তৈরি করেছিল বিজেপি। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকারের অনেক বাধ্যবাধকতা ছিল।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বদলও খেয়াল করেছে অযোধ্যা। মুরলীমনোহর জোশীর ‘একতা যাত্রা’য় অযোধ্যায় এসে ‘জয় শ্রীরাম’ বলেছিলেন গুজরাতের বিজেপি নেতা মোদী। কিন্তু ২০১৪ সালের ভোট বা তার পরেও তাঁর মুখে আর ওই ধ্বনি শোনা যায়নি। এমনকি, দ্বিতীয় বার জিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে অযোধ্যায় ভূমিপূজনের দিনেও নয়। তিনি স্থানমাহাত্ম্য বিবেচনা করেই বলেছিলেন, ‘‘সিয়াবর রামচন্দ্র কি জয়, জয় সিয়ারাম।’’ রামের সঙ্গে অযোধ্যার জানকীমাতাকে স্মরণ করতে ভোলেননি। আবার ২০২১ সালে বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বলেছেন, ‘‘বিরোধীদের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে এত ভয় কেন?’’ একটা সময়ে বাংলায় এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, বিজেপি কেন ‘জয় সীতারাম’ ধ্বনি দেয় না। ‘নারীবিদ্বেষ’ থেকে? নিজেদের মতো করে তার মোকাবিলা করেছে বিজেপি। সংসদে এখন বিরোধীদের থামাতে বা দলের নেতাদের উৎসাহ দিতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলেন মহিলা-পুরুষ সব সাংসদই।

প্রবল ঠান্ডা এখন উত্তরপ্রদেশ জুড়ে। সরযূপারের কাছাকাছি রাম কি পৌরিতে প্রহরারত পুলিশকর্মীদের কপালেও ‘জয় শ্রীরাম’ তিলক। বিদায় জানিয়ে জয়রাম বললেন, ‘‘জয় সিয়ারাম।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Ayodhya Ram Mandir Ayodhya Ram Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy