হস্টেলের ঘরে সূর্য । নিজস্ব চিত্র।
সাবরমতী হস্টেলের ৫১ নম্বর ঘরে এসেছি মাস ছয়েক। কিন্তু ঘরের দেওয়ালে যে বাবাসাহেব অম্বেডকরের ছবি আঁকা আছে, তা জানতাম না। একেবারেই চোখে দেখতে পাই না তো। ছবির কথা জানলাম রবিবার সন্ধ্যায় বেধড়ক মার খেয়ে। যারা মারতে এসেছিল, তাদের কাউকে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বার বার বলতে শুনলাম, ঘরে অম্বেডকরের ছবি সাঁটা, নির্ঘাৎ বামপন্থী। পেটাও।
কেউ বলছিল, আসলে অন্ধ নয় মনে হয়। বেধড়ক ঠ্যাঙানো হোক। জীবনে এই প্রথম অন্ধ পরিচয় দিয়ে মার থামাতে বলেছি। প্রাণভিক্ষা চেয়েছি কার্যত। পরে তার জন্য অসম্ভব লজ্জা পেয়েছি, নিজের কাছেই। সেই মুহূর্তে আর কিছু করারও ছিল না সম্ভবত। সারা গায়ে মারের যন্ত্রণা তবু মিলিয়ে যাবে, কিন্তু যে ভয়, আশঙ্কা, আতঙ্কের সাক্ষী থাকলাম, তার স্মৃতি চট করে মুছে যাওয়া শক্ত।
আমি সংস্কৃত নিয়ে গবেষণা করছি। প্রথম বর্ষের ছাত্র। এর আগে স্নাতকের পাঠ সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে।
হামলার আগেই আমাকে জনা কয়েক বন্ধু সাবধান করেছিল, যে ঘরে-ঘরে লাঠি নিয়ে পড়ুয়াদের মারধর করছে এক দল দুষ্কৃতী। বলেছিলাম, আমার সঙ্গে তো রাজনীতির যোগ নেই। তার উপরে আমি দৃষ্টিহীন। তাই চট করে আমার গায়ে হাত তুলবে না হয়তো।
কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় প্রথমে দরজায় ধাক্কা। তারপরেই ঝনঝনিয়ে কাচ ভেঙে পড়ার আওয়াজ। বুঝলাম, দরজার উপরের কাচ ভেঙে, সেখান দিয়ে হাত গলিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলছে দুষ্কৃতীরা। তার পরেই বেধড়ক মার। হাতে, পিঠে। সারা পিঠ ফুলে রয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা। মাথায় চোট পাইনি এই ঢের। মার চলাকালীন অকথ্য গালিগালাজ শুনেছি। শেষে অবশ্য কেউ এক জন বলেছিলেন, ‘‘নাহ্, সত্যিই অন্ধ। ছেড়ে দাও।’’ তবে মার থেকে রেহাই।
মার খাওয়ার পর থেকে বাড়ির লোক কান্নাকাটি করছে। হয়তো ওঁদের দুশ্চিন্তা কমাতে বাড়ি যাব। কিন্তু আমার ভয় কেটে গিয়েছে গত রাতেই। হামলার পর থেকে বহু বার ফোন পেয়েছি। হুমকি এসেছে মুখ না-খোলার। বলা হয়েছে, তাতে নাকি সমবেদনা তৈরি হতে পারে। তবু এই যে নিজের নামে লিখছি, তার কারণ ভয় ভেঙে যাওয়া।
হালে শুনেছি, তিন-তিনটে কেন্দ্রীয় সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় করার কথা বলেছে মোদী সরকার। এই ভাষাকে নাকি ভারতের সনাতন সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে তুলে ধরে তারা। অথচ তারই দৃষ্টিহীন গবেষক হিসেবে এই অবস্থার মুখে পড়তে হল আমাকে!
বন্ধুদের মুখে শুনেছি, সংসদে সংবিধানকে প্রণাম করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাহলে তার রচয়িতার ছবি আমার ঘরের দেওয়ালে থাকার জন্য আমাকে মার খেতে হল কেন? এটাই তাহলে আসল ছবি?
মার খাওয়ার পরে পুলিশের কাছে ফোন করেও ‘দেশদ্রোহী’, ‘ঠিক হয়েছে’ জাতীয় কথা শুনতে হয়েছে আমাদের অনেককে। মারের সময়ে দৃষ্টিহীনতার জন্যও শুনতে হয়েছে বিদ্রুপ!
অবশ্য দেশের এই চেহারা বোধহয় দেখতে না-পাওয়াই ভাল। কে জানে!
(সংস্কৃতে পিএইচডি-র ছাত্র, প্রথম বর্ষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy