শ্রীনগরে নিজের ঘরে সৈয়দ আলি শাহ গিলানি। তিন মাস ধরে গৃহবন্দি রয়েছেন এই হুরিয়ত নেতা। — নিজস্ব চিত্র।
‘হিন্দুস্থানের’ কোনও নেতার সঙ্গে আলোচনা করেননি কোনও দিন। দীর্ঘদিন অংশ নেন না ভোটে। আবার সন্ত্রাসেও সায় নেই তাঁর। তিনি শুধু এক দেখতে চান দুই কাশ্মীরকে। চান অখণ্ড কাশ্মীরের আজাদি। কোন পথে? জানতে চাইলে সরাসরি এর উত্তর দেন না সৈয়দ আলি শাহ গিলানি!
৮৬ বছরের দোরগোড়ায় এসে শ্রীনগরে রাজ্য পুলিশের হাতে গৃহবন্দি এই হুরিয়ত নেতা বলেছিলেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কথা। অটলবিহারী বাজপেয়ীই হোন বা নরসিংহ রাও— গিলানির নিজের ভাষায়, ‘‘হিন্দুস্থানের কোনও নেতার সঙ্গে আজ পর্যন্ত দেখা করিনি।’’ তবে ‘‘তার মানে এই নয় যে আমি আলোচনার বিরুদ্ধে। সেনা-দৌরাত্ম্য, নিরীহ কাশ্মীরিদের উপর অত্যাচার যদি বন্ধ হয়, তখন আলোচনার পরিবেশও তৈরি হতে পারে।’’
তবে কি নতুন কোনও সম্ভাবনা উস্কে দিতে চাইছেন গত তিন মাস ধরে গৃহবন্দি এই হুরিয়ত নেতা! শ্রীনগরে তাঁর বাসভবন, ৫ নম্বর আবাদ হায়দরপুরায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। বাইরে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের ভ্যান। ঝুলছে গিলানির প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-হুরিয়ত-এর সাইনবোর্ড। এমনিতে তাঁর বাসভবনে ঢোকা বা তাঁর সঙ্গে দেখা করা নিষিদ্ধ। রাজ্য পুলিশের ডিজি-র থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করা গেল গিলানির সঙ্গে। ঘণ্টা দু’য়েকের সুদীর্ঘ আলোচনায় পাওয়া গেল এক নতুন গিলানিকে। যিনি মনে করেন, বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে সরকার গড়ায় মুফতি মহম্মদ সইদ কাশ্মীরে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। বাড়ছে জঙ্গি কার্যকলাপ। জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে মেরুকরণ বাড়ছে। আবার ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেসের শাসনের স্মৃতি এখনও কাশ্মীরের মানুষের কাছে দুঃস্বপ্ন। জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন হুরিয়তেরও বহু নেতাও। এই অবস্থায় রাজ্যে যে আবার একটা নতুন রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হচ্ছে সেটা গিলানির কাছে বেশ স্পষ্ট।
তবে কি আপনি এ বার সংসদীয় রাজনীতিতে সক্রিয় নিতে পারেন? আপনি কি কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবেন?
সরাসরি জবাব না-দিয়ে একটু ঘুরিয়ে গিলানি বলেন, ‘‘আমি তো তিন বার বিধায়ক হয়েছি। সুতরাং আমি সংসদীয় রাজনীতি করিনি, এমন নয়। কিন্তু এখানে সেনাবাহিনী অবাধ নির্বাচন হতে দেয় না। যে ভাবে সেনাবাহিনীকে দিয়ে ফারুক আবদুল্লাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল, তা দেখে আমি ভোট বয়কটের রাস্তা নিতে বাধ্য হয়েছি।’’
গিলানির এই মন্তব্য দেখে দিল্লির রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, সেনাবাহিনীকে সংযত করার পূর্বশর্ত দিয়ে হয়তো কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনার দরজা খুলতে চান তিনি। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক আলোচনাকে ফলপ্রসূ করতে তিনি কোনও সদর্থক ভূমিকা পালন করতে পারেন, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাস্তবে এমন সম্ভাবনা আছে কি না, সেই প্রশ্নের সরাসরি জবাব গিলানি দেননি, কিন্তু ভাবনাগুলি উস্কে দিয়েছেন।
এবং গিলানির দেওয়া ইঙ্গিতের সূত্র ধরে ইতিবাচক বার্তা মিলছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের অন্দরমহল থেকেও। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই কাশ্মীরের রাজ্যপাল নরেন্দ্রনাথ ভোরার সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। গিলানির সঙ্গে কেন্দ্র আলোচনায় বসলে মুফতি মহম্মদ সইদও যে আপত্তি করবেন না, তেমন আশ্বাসও মিলেছে বলে খবর। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্র বলছে, আলোচনায় বসার আগে গিলানিকে পাল্টা পূর্বশর্ত দেওয়ার পক্ষপাতী সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ। সেটা হল, কাশ্মীর উপত্যকায় হিংসা বর্জনের কথা বলতে হবে তাঁকে।
গিলানি অবশ্য প্রকাশ্যেই ইসলামি মতাদর্শের নামে যে হিংসা চলছে তার বিরোধী। তিনি বলেন, ‘‘ইসলামে সন্ত্রাসের কোনও স্থান নেই। মানুষকে হত্যা করা কখনও ইসলাম ধর্ম হতে পারে? কোরানে আত্মরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসের কথা কখনও বলা হয়নি। কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে কাশ্মীরিরা অনেক সময় সংঘর্ষে গিয়েছে। কিন্তু যারা ইসলামের নামে মানুষকে হত্যা করছে, তারা আর যা-ই হোক, কাশ্মীরের উপকার করছে না।’’
আলোচনা চলতে চলতে এল কাশ্মীরি রুটি আর নুন দেওয়া চা। কাঠের মেঝেতে গালিচা। ঘরের চার দিকে কোরান ও ইসলামি নানা ধর্মগ্রন্থ। লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতোই এখনও বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। সকালে রোজ দু’ঘণ্টা শরীরচর্চা করেন। কিন্তু শুক্রবারের নমাজ পড়তেও মসজিদে যাচ্ছেন না। কেন?
গিলানি বলেন, ‘‘রাজ্য পুলিশের ডিজি বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, নমাজ পড়তে যেতে বাধা নেই। সেই মতো বেরিয়েছিলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন বুঝলাম, ওরা মিথ্যা কথা বলছে। সেই প্রতিবাদে আমি শুক্রবারের নমাজ পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’’
ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির প্রসঙ্গ উঠলে গিলানি বলেন, ‘‘কাশ্মীরের কোনও দল বা নেতা এ বিষয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি। তার কারণ, মকবুল ভাট বা আফজল গুরুর ফাঁসির সঙ্গে এই ফাঁসির একটি মৌলিক ফারাক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিষয়টা জেহাদ নয়, অপরাধমূলক কার্যকলাপ। তা ছাড়া, লোকটি কাশ্মীরি নয়। উত্তরপ্রদেশ, লখনউ বা হায়দরাবাদের সঙ্গে কাশ্মীরি সমাজের ফারাক রয়েছে।
তা ছাড়া, বিষয়টি সম্পূর্ণ না জেনে আমি এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’
প্রশ্ন হল, গিলানিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? গিলানির দলের মুখপাত্র বলেন, সম্প্রতি তিনি মুফতি-সরকারের বিরুদ্ধে শ্রীনগর উপত্যকায় ১০ লক্ষ মানুষের সমাবেশ করবেন বলে হুঙ্কার দিয়েছিলেন। মানুষ গিলানিকে বিপুল ভাবে সমর্থন করছে। সেই ভয়েই গিলানিকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। তবে সরকারের অভিযোগ, গিলানি আসলে পাকিস্তানের এজেন্ট। সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, তিনি যদি পাকিস্তানের এজেন্ট হন, তা হলে তাকে সম্প্রতি সৌদি আরবে তাঁর অসুস্থ মেয়েকে দেখতে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা দেওয়া হল কেন? তাঁর মেয়ে চিকিৎসা করিয়ে এখন অবশ্য শ্রীনগরেই চলে এসেছেন এবং গিলানির কাছেই রয়েছেন। তাই এখনই কাশ্মীর ছেড়ে গিলানি কোথাও যাচ্ছেন, এমনটাও নয়। গিলানির বক্তব্য, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রাখা হয়েছিল। ভিসা দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ভারত সরকার এই ভিসা দিয়েছে।’’
প্রশ্ন এটাও, ভারত সরকার যাকে ভিসা দিয়েছে, তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে কেন? দিল্লিতে কর্মরত পাকিস্তান হাইকমিশনার আবদুল বসিত গিলানিকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক বাতিল করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গিলানির বক্তব্য, ‘‘আমার দিল্লি যাত্রার বিষয়টি ভারত সরকারের অজানা ছিল না। কাশ্মীর থেকে তা হলে আমাকে দিল্লি যাওয়ার ছাড়পত্রই বা দেওয়া হয়েছিল কেন?
তা ছাড়া, আমরা কাশ্মীরের আজাদি চাই। পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি তো চাই না। দু’টো কাশ্মীরকে একত্রিত করতে চাই আমরা। চাই ১৯৪৭ সালের আগে এ বিষয়ে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy