Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Manipur Violence

ভিডিয়ো লিঙ্ক খুলে আমি স্তম্ভিত, এই মণিপুরে আর ফিরতে চাই না, লিখলেন ইরম শর্মিলা চানু

আমায় ওই ভিডিয়োর লিঙ্কটা শেয়ার করেছিলেন এক মহিলা সাংবাদিক। ভিডিয়োটা দেখে কেঁদে ফেলি। কী ভাবে মানুষ পারে এই কাজ করতে? কতটা নিষ্ঠুর কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে এই রকম কাজ করা যায়?

Refugee center

ইম্ফলের একটি শরণার্থী শিবিরে শিশুরা। ছবি: পিটিআই।

ইরম শর্মিলা চানু
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ ০৭:২৫
Share: Save:

দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। ফোনে আসা ভিডিয়োর লিঙ্ক খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ঠিক কী ভাষায় একে বর্ণনা করব, এখনও উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

মণিপুরের দুই তরুণীকে যে ভাবে বিবস্ত্র অবস্থায় হাঁটানো হচ্ছিল, যে ভাবে শয়ে শয়ে পুরুষের চোখ তাদের ধর্ষণ করছিল, যে ভাবে তাদের শরীরে অবাঞ্ছিত হাত এসে পড়ছিল— দেখতে দেখতে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, শুধু ওঁরা দু’জন নন, ভয়াবহ ঘটনাটা যেন ঘটে চলেছে আমার সঙ্গেও, যেন নিগ্রহের শিকার আমিও! আমার সে দিনের ওই অনুভূতির সঙ্গে কম-বেশি সব মেয়েই একমত হবেন। মণিপুরের ওই অসুস্থ-ভিডিয়ো দেখে সব মেয়েই মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাটাচ্ছেন।

আমায় ওই ভিডিয়োর লিঙ্কটা প্রথম শেয়ার করেছিলেন এক মহিলা সাংবাদিক। ভিডিয়োটা দেখতে দেখতে আমি কেঁদে ফেলি। কী ভাবে মানুষ পারে এই কাজ করতে? কতটা নিষ্ঠুর কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে এই রকম কাজ করা যায়? এ ক্ষেত্রে আমি অন্তত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সেই সব অত্যাচারী-ধর্ষক আর মণিপুরের ওই উন্মত্ত পুরুষ-ভিড়ের মধ্যে কোনও ফারাক দেখতে পাইনি। এদের সকলের কাছেই নারী-শরীর হল সফ্‌ট-টার্গেট। যাকে নগ্ন করে দিয়ে শায়েস্তা করা হয়, নিজেদের পৌরুষ, ক্ষমতা জাহির করতে হয়। মণিপুরের মেয়েদের বরাবর এই নিপীড়নের মধ্যে পড়তে হয়েছে। কখনও তা এসেছে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে, কখনও আবার জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভাজন কিংবা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে। পুরুষের পারস্পরিক বিদ্বেষ, আগ্রাসন নিবারণের অস্ত্র হিসাবে মেয়েদের ব্যবহার করা হয়েছে। যৌন লাঞ্ছনা, নিগ্রহের মধ্যে দিয়ে আজও প্রতিনিয়ত তাঁদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে চলেছে। যেমনটা ঘটেছিল থাংজাম মনোরমার ক্ষেত্রে। কিংবা ঘটে চলেছে বর্তমান সময়ের নগ্ন-প্যারেডে, গণধর্ষণে।

আমি যখন আফস্পা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করেছি, নিজের যাবতীয় স্বার্থ ভুলে জীবনের মূল্যবান সময় অনশনে-জেলে অতিবাহিত করেছি, তখনও আমি ছিলাম শুধুমাত্র একজন মেয়ে। সে ভাবেই আমায় দেখা হত। আমি মণিপুরের মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।

অথচ আমার অনশনের শুরু কিন্তু মণিপুরের মানুষের প্রতি অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়েই।

ইম্ফল উপত্যকার মালোম বাসস্ট্যান্ডের ঘটনা। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর। সেই দিনটাও বৃহস্পতিবার। মালোমে নিরীহ দশ জন মণিপুরি নাগরিককে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে সেনাবাহিনী। ওই ঘটনার পর উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি থেকে আফস্পা (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স আক্ট, ১৯৫৮) প্রত্যাহারের জন্য শুরু হয় আমার অনশন। আঠাশ বছরের আমি ঠিক করি, এর প্রতিবাদে অনশন চালিয়ে যাব। কারণ, মণিপুর আমার মাতৃভূমি। তার রক্তক্ষরণ হলে আমারও ক্ষয় হয়। এরও চার বছর পর ঘটে মনোরমা-ধর্ষণের মতো ঘটনা। যে ঘটনায় মণিপুরের মায়েরা নগ্ন হয়ে রাস্তায় নামেন, ভারতীয় সেনার ধর্ষণের প্রতিবাদ করেন। বিশ্বের নজরে উঠে আসে মণিপুর। সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে কথা ওঠে। তবে টানা ষোলো বছরের অনশনের পরেও যখন কিছু বদলায় না, ঠিক করি, স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসব। লড়াইটা গণতান্ত্রিক উপায়ে লড়ব। সে সময়ে কিন্তু মণিপুরের মানুষ কিংবা পরিবার, কাউকে পাশে পাইনি। উল্টে শুরু হয়েছিল সমালোচনা। কিন্তু নিজের জীবন কী ভাবে বাঁচব, সেটা ঠিক করা তো আমার অধিকার! যেমন রাষ্ট্রের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্তও আমার গণতান্ত্রিক অধিকার।

এখন মণিপুরে মানুষ নিজেদের মধ্যে লড়াই করে এলাকায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় দিয়ে এক মানুষ অপর মানুষকে চিনছে। এই মণিপুরে আমি কোনও দিন ফিরে যেতে চাই না। ওখানে মেয়েদের কোনও সুরক্ষা নেই। সকলের চোখেই সে একটি নিগ্রহ-যোগ্য নারীশরীর মাত্র, এর বাইরে তার কোনও সামাজিক পরিচয় নেই।

এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পিছনে প্রশাসনের দায় কম নয়। আমার তো ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, নরেন্দ্র মোদীর কোনও যোগ্যতা নেই এখনও প্রধানমন্ত্রী পদে বসে থাকার। বিদেশ ভ্রমণ আর ভাষণ দেওয়া ছাড়া মোদীকে আর কোনও সদর্থক ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি এই তিন মাসে। ঠিক যেমন ঘটেছিল গুজরাত হিংসার সময়েও। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহও ওই পদে থাকার যোগ্য নন। মেইতেই-কুকি সম্প্রদায়ের হিংসা রুখতে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। ফল যা হওয়ার, তাই হয়েছে।

ওই হাজার জনতার ভিড়ে দুই তরুণীর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নিশ্চয়ই দোষীরা শাস্তি পাক, মনেপ্রাণে চাইব। একই সঙ্গে আরও একটা কথা মনে করিয়ে দেব। মণিপুরের পুরুষদের এই যৌন বিকার, মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার পিছনে রাষ্ট্রের ভূমিকাও অনেকখানি। মাসের পর মাস ওখানে কর্মচারী, শ্রমিকদের মাইনে হয় না। কাজের সুযোগ নেই, চাকরি নেই, রোজগার নেই। ঘরে ঘরে দারিদ্র্য। কঠিন জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকা। কখনও আবার তার মধ্যেও জাতি-গোষ্ঠী সংঘর্ষ। যুবকেরা মাদক সেবন করে নেশাসক্ত হয়ে পড়ে থাকছে। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ-হতাশা, অত্যাচার-নির্যাতনের সহজ লক্ষ্য হয়ে উঠছে মেয়েরা।

অনুলিখন: চৈতালি বিশ্বাস

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Violence Irom Chanu Sharmila Manipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE