রসুল গালওয়ানের নাতি কেঁদে ফেলেন। এখানে রক্তপাত হচ্ছে শুনে। তিব্বত-ভারত সীমান্তে গালওয়ান হল তাঁর লাদাখি অভিমান। ফাইল চিত্র।
‘আমরা তিব্বতিদের মতো দেখতে, এটা আমার মোটেই পছন্দ নয়। ওরা আমাদের দেখলেই লাসার সরকারের কাছে রিপোর্ট করে দেয়। সে আর এক বিড়ম্বনা...।’ বইয়ের নাম ‘সারভেন্ট অব দ্য সাহিবস’। লেখক গুলাম রসুল গালওয়ান।
ভাগ্যিস গালওয়ান উপত্যকায় ভারত-চিনের এই ঘটনাবহুল সংঘর্ষ হল। নইলে গালওয়ান নামের এক উপত্যকা আছে, তাও জানতাম না, পড়া হত না যাঁর নামে ওই উপত্যকা সেই গোলাম রসুল গালওয়ানের অবিশ্বাস্য ওই বই।
গত ক’দিনে পাঠকও নিশ্চয় আমার মতোই কয়েকটি শব্দ শুনতে শুনতে বিরক্ত। পেট্রল পয়েন্ট ১৪। ফিঙ্গার টিপ চার থেকে আট। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
বছর দশেক আগে প্রথম যখন লাদাখ এসেছিলাম, প্যাংগং দেখার সুযোগ হয়েছিল। টেথিস সাগরের আদিম জলের চিহ্ন নিয়ে এখনও দিন রাত রং বদলায় বিশাল এই হ্রদ। যার এক তৃতীয়াংশ ভারতের, দুই তৃতীয়াংশ চিনের। প্রায় ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় নোনা জলের ধারে বসে চিনের পাহাড়ে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে আড্ডা জমে পেট্রলিংয়ে বেরনো এক সেনা জওয়ানের সঙ্গে। হাতের আঙুল দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন লেক বরাবর ভারত-চিন সীমান্ত। আর আড্ডা হয়েছিল হ্রদের ধারে অস্থায়ী টেন্ট তৈরি করে রাখা এক নোম্যাডিক পরিবারের সঙ্গে। এ বার লেহ্ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম আপাতত।কিন্তু সংঘাতের উত্তাপে আগের সেই রাস্তা বন্ধ।
প্যাংগং হ্রদ। টেথিস সাগরের আদিম জলের চিহ্ন নিয়ে এখনও দিন রাত রং বদলায়। এর এক তৃতীয়াংশ ভারতের, দুই তৃতীয়াংশ চিনের। ফাইল চিত্র।
আরও পড়ুন: করাচিতে পাক স্টক এক্সচেঞ্জে জঙ্গি হানা, গুলিতে মৃত অন্তত ৫
প্যাংগংয়ের যে ফিঙ্গার টিপ নিয়ে ভারত এবং চিনের এই সীমান্ত জটিলতা, সেখানে গাড়ি পৌঁছয় না। অতি সংকীর্ণ সেই পথ ধরে এক বারে একজন মানুষই কেবল যাতায়াত করতে পারেন। সীমান্ত সঙ্কট বুঝতে হলে কেবল ওই কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। সেটা সেনা এবং কূটনীতিকদের কাজ। সংকটের গভীরে ঢুকতে হলে পৌঁছতে হবে মানুষের ইতিহাসে।
প্যাংগং হ্রদ কেবল একটি স্ট্র্যাটেজিক লেক নয়। তাকে ঘিরে রেখেছে প্রায় ৩৫ হাজার বর্গফুটের বিশাল এক মালভূমি। লাদাখ থেকে তিব্বত পর্যন্ত সেই মালভূমির নাম চাংথাং। যাযাবর বা নোম্যাডিক ট্রাইবরা এই মালভূমি বেয়ে ঘুরে বেড়ান। যেখানেই সবুজের সামান্য আভাস, সেখানেই তাঁবু খাটিয়ে ভেড়ার পাল ছেড়ে দেওয়া হয় তৃণভূমিতে। আট চালার তাঁবুর মাথায় ধোঁয়া বেরনোর ফুটো। চমরীর চামড়ার ব্যাগে দুধ পিটিয়ে মাখন তৈরি হয়। তিব্বত থেকে আনা পাথর একে একে গেঁথে মেয়েদের মুকুট আর ছেলেদের বেল্ট তৈরি হয়। কাঁটাতারহীন এই বিশাল প্রাণবর্জিত এলাকায় নোম্যাডরা ঘুরে বেড়ান কখনও তিব্বত কখনও লাদাখ। আজ থেকে নয়, সভ্যতার গোড়ার কাল থেকে। ইদানীং পর্যটনের মরসুমে, প্যাংগংয়ের ধারে তাঁবু ফেলেন তাঁরা। তিব্বতি মাখন চা, থুকপা— দু’পয়সা রোজগার। তরুণ প্রজন্মের এই লোভ অবশ্য ভাল চোখে দেখেন না দাদা-দাদিরা।
চাষির ছেলে আর চাষি হতে চান না। তরুণ নোম্যাডও কম্পিউটার শিখতে চান। যাযাবর অভ্যাস থেকে নিজেকে বাইরে আনতে চান, যাযাবর সংস্কৃতি থেকে নয়। লেহ্-র নিরাপদ আশ্রয়ে যুদ্ধ দেখতে আসা সাংবাদিকের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল তেমনই এক শহুরে নোম্যাডের। দশ বছরের আলাপ, এখন সম্পর্ক অনেকটাই পারিবারিক। চিনের সেনা এই চাংথাং মালভূমির বেশ কিছু অংশে যে যাতায়াত শুরু করেছে, স্থায়ী কাঠামো তৈরি করেছে, তা শুধু শোনেনই নি, দেখেওছেন এই ছেলেটি। ইনফরমারের খবর পৌঁছেছে ভারতীয় সেনার নিকটবর্তী ক্যাম্পে। কিন্তু লাভ হয়নি। ‘দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কথার আমল দেননি কেউ’— এক ঢোকে অনেকটা নামকিন চায় শেষ করলেন বন্ধু।
কেউ বলছেন ১০ কিলোমিটার, কেউ বলছেন ৭০, লাদাখিরা বলছেন অনেকটা— প্রধানমন্ত্রী যা-ই বলুন, লাদাখ সীমান্তে চিনের অনুপ্রবেশ যে ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রায় পুরো লাদাখই নিশ্চিত। প্যাংগংয়ের ফিঙ্গার টিপ ৪ থেকে ফিঙ্গার টিপ ৮ পর্যন্ত দুই দেশের বিতর্ক নিয়ে এতটুকু চিন্তিত নন লাদাখের সাধারণ মানুষ। চিন্তিত নন গালওয়ানের পেট্রল পয়েন্ট ১৪ নিয়েও। গাড়ি তো দূরের কথা, এক সঙ্গে কয়েক জনের পক্ষেও সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। লাদাখিরা ইতিহাসকে ভয় পাচ্ছেন।
তরুণ নোম্যাড কম্পিউটার শিখতে চান। যাযাবর অভ্যাস থেকে নিজেকে বাইরে আনতে চান, যাযাবর সংস্কৃতি থেকে নয়। —ছবি রিতায়ন মুখোপাধ্যায়।
কী সেই ইতিহাস? ১৮৯৩-৯৪ সালে টিনএজার রসুল গালওয়ান একদল ব্রিটিশ পর্যটকের গাইড হয়ে তিব্বতের রাস্তায় গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ দলের নেতা ছিলেন ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ড। মধ্য এশিয়া থেকে কাশ্মীর উপত্যকা পর্যন্ত বিপুল এই দুর্গম এলাকা হাতের তালুর মতো চিনতেন রসুল। কিন্তু ১৮৯৩-৯৪ এর সেই অভিযানে পথ ভুল হয়। আবহাওয়া আরও খারাপ হয়। কার্যত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শুরু হয় পর্যটক দলের। এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারত-তিব্বত সীমান্তে একটি নালা বা নদীর হদিস পান দলের গাইড রসুল। জল মেলে। প্রাণ বাঁচে। রসুলের চেষ্টায় সেই বিপজ্জনক অঞ্চল থেকে নদী উপত্যকা ধরে সভ্যতায় ফেরেন অভিযাত্রীরা। রসুলকে ভালবেসে ব্রিটিশ সরকার সেই নদীর নাম দেয় গালওয়ান। উপত্যকার নামও হয় রসুলের নামে। সঙ্গে অনেকটা জমি।
অভিযাত্রীদের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সম্পূর্ণ নিরক্ষর রসুল ইংরেজি এবং চিনা শিখে নেন। ইংরেজিতে লিখে ফেলেন নিজের গল্প। আত্মকথা। সারভেন্ট অব দ্য সাহিবস।
আরও সকলের মতোই রসুল নিজেকে লাদাখি মনে করতেন। স্ক্রিপ্ট এক, খাদ্যাভ্যাসে অসম্ভব মিল, লাসার বুদ্ধ লাদাখের বুদ্ধ, তিব্বতের মেয়ে লাদাখের বউ, এমনকি তিব্বতে জমি— খুঁজলে এখনও এমন প্রবীণ মানুষের খোঁজ মেলে লাদাখে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল ইস্টবেঙ্গলই, মোহনবাগান মোহনবাগান। কোনও দিনই তিব্বতকে লাদাখের সঙ্গে মেলাতে চাননি স্থানীয় মানুষ। বৌদ্ধ-মুসলিম নির্বিশেষে। নেপাল প্রসঙ্গে দার্জিলিংয়ের গোর্খাদের মধ্যেও এক সময় এ অভিমান ছিল। এখন আছে কি না জানি না। কার্গিল ধরলে, লাদাখে বৌদ্ধ-মুসলিম ৫০-৫০ ভাগ। এ বিষয়ে লাদাখিরা গর্বিত। মুসলিম বরের বৌদ্ধ স্ত্রী এখানে স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক ঘোড়া ছুটিয়ে তিব্বত থেকে প্রেমিকাকে নিয়ে আসা। এখনও তিব্বতি বৌদ্ধ এবং লাদাখি মুসলিমের পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় লাদাখে। বিয়ের জন্য ধর্ম বদলাননি কেউ। এক রকম প্রেম-যুদ্ধের সম্পর্ক ছিল দুই অংশের। প্রায় দেড়শো বছর আগে মুসলিম লাদাখি তাই অমন বাক্য লিখতে পারেন। নিজেকে তিব্বত থেকে বিযুক্ত করেন লাদাখি সম্ভ্রমে। পাশাপাশি আশঙ্কাও একটা ছিল। সাংস্কৃতিক ভাবে লাসা গিলে ফেলবে না তো লেহ্-কে? লাদাখ থেকে তিব্বতে ঢুকলে লাসার কাছে খবর পৌঁছতো, এ কথা লিখেছেন রসুল।
আরও পড়ুন: অনন্তনাগে নিহত হিজবুল কম্যান্ডার-সহ ৩ জঙ্গি, কাশ্মীরে বড়সড় সাফল্য বাহিনীর
লাদাখের মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন— চিন নয়, তাঁদের সীমান্তে তিব্বত। বিশ্বাস করেন, চিন ১৯৫০ সালে বেআইনি ভাবে দখল করেছিল তিব্বত। সেই চিন যখন লাদাখ সীমান্তে গলাবাজি করে, তখন এই অঞ্চলের সারভেন্ট অফ দ্য সাহিবের বংশধররা ভারতের পক্ষে থাকেন। তিব্বত-চিনের ইতিহাসকে তাঁরা লাদাখে দেখতে চান না। এ ভয় কি অমূলক? বিশ্ব কূটনীতিতে এর বিস্তর ব্যাখ্যা হতে পারে। লাদাখ আপাতত ব্যাখ্যা শুনতে রাজি নয়। হংকং এবং তাইওয়ান নিয়েও তাঁদের মাথাব্যথা নেই।
এখনও তিব্বতি বৌদ্ধ এবং লাদাখি মুসলিমের পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় লাদাখে। বিয়ের জন্য ধর্ম বদলাননি কেউ। ফাইল চিত্র।
বছরে অন্তত ছ’মাস বাকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে শীতল মরুভূমি। শ্রীনগর থেকে জোজিলা হয়ে লে, মানালি থেকে রোটাং এবং সার্চু হয়ে লেহ্, দুটো রাস্তাই বরফের তলায় চলে যায়। সৈন্য থাকে। তবে আপৎকালীন প্রয়োজনে সম্পূর্ণ পে লোড নিয়ে উড়তে পারে না বায়ুসেনার বিমান। লাদাখিদের বক্তব্য, সীমান্ত ধরে দীর্ঘদিন ধরে চিন যে নির্মাণ কাজ করেছে, তাতে তিব্বতের ঠান্ডা চিনের জন্য ততটা সমস্যার কারণ নয়। ফলে বরাবরই শীতকালকে কাজে লাগায় চিন। তিন পা ঢুকলে বিতর্ক হয়। এক পা পিছলে কূটনৈতিক রফায় পৌঁছনো যায়। ভারতও কি একই কাজ করে না? ভারতের এক প্রাক্তন সেনাপ্রধান ঘরোয়া আড্ডায় বলেছিলেন— ভারতও করে, তবে এ খেলায় পিএলএ (পিপলস লিবারেশন আর্মি)-র সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল।
লাদাখের বক্তব্য, ঐতিহাসিক সময় থেকে তিব্বতের দাদাগিরি তাঁরা মেনে নেননি, ফলে চিনের মাতব্বরিও তাঁরা মানবেন না। যে নিয়মে ভারত সরকার তাঁদের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করেছে তা তাঁরা শুধু অন্যায় নয়, অপমানজনক বলেও মনে করছেন। কিন্তু চিন প্রসঙ্গে তাঁরা ভারতের পাশে। কিন্তু ভারত তাঁদের বিশ্বাস করছে কি? লাদাখের আনাচেকানাচে কান পাতলে অভিযোগ শোনা যাবে, স্থানীয় খবরকে অনেক সময়ই পাত্তা দেয় না মূল ভূখণ্ডের ভারত।
লেহ্ শহর। পিছনে কারাকোরাম পর্বতমালা। কাঁটাতার না থেকেও সীমান্ত বিরোধের কাঁটা বিঁধে চলেছে শান্তিপ্রিয় মানুষের এই জনপদে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, চিন ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি, কাঠামোও নির্মাণ করেনি। সমস্যা হল, দুর্গম লাদাখে হাওয়াতেও পাথর নড়ে। হাতাহাতি হয় দুই পক্ষের। দুই ইঞ্চি জমির জন্য মল্লযুদ্ধ মূলস্রোতের ভারতে উত্তেজক খবর হয়। টেলিভিশনের হাই পিচ তরজায় কিছু টেকনিক্যাল নাম বলতে পারলে টিআরপি চড়ে। কিন্তু যে প্রশ্ন আলোচনায় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের মতো হারিয়ে থাকে, তা হল— স্থানীয় সমাজ, স্থানীয় আবেগ, মানুষের ইতিহাস। একটি স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টের দখল-বেদখলে ইতিহাস বদলে যায় না। কিন্তু দীর্ঘ সীমান্ত সংঘাত ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে।
রসুল গালওয়ানের নাতি সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। না, গালওয়ানের ১৪ নম্বর পেট্রল পয়েন্ট দখল বেদখলের খবর শুনে নয়, সেখানে রক্তপাত হচ্ছে শুনে। ঠাকুরদাদার পবিত্রভূমিতে ফুলের গাছের গালিচার কল্পনা ছিল তাঁর। কূটনীতি-রণনীতির কিচ্ছু বোঝেন না তিনি। কেবল একটাই বিষয় জানেন, লাদাখি অভিমান। তিব্বত-ভারত সীমান্তে গালওয়ান হল তাঁর লাদাখি অভিমান।
পুনশ্চ: স্ট্র্যাটেজির বহু নীরস আলোচনা শুনে ফেলেছি। নিশ্চয় আপনারাও। ভারত-পাকিস্তান-নেপাল-সাউথ চায়না সমুদ্র আরও কত কী! তবু একবার মনে করিয়ে দিই, গালওয়ান স্ট্র্যাটেজি চিনের পক্ষে গেলে মূল লাদাখের থেকে চাংথাং মালভূমিকে আলাদা করা সম্ভব। যদি তা হয়, তা হলে ভারতের গর্বের সুউচ্চ এবং বিতর্কিত এয়ার স্ট্রিপের দফারফা তো হবেই, লাদাখের গর্বও অনেকটা ধাক্কা খেয়ে যাবে। লাদাখ সেই চোট পেলে ভারতের ক্ষত মেরামতিতে অনেকটা সময় লেগে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy