জো বাইডেন (বাঁ দিকে) এবং নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
বৃষ্টিভেজা দিল্লির রাজঘাটে গান্ধী স্মারকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত রাষ্ট্রপ্রধানেরা। বৈঠকের শেষ দিনে ঐক্যের এই ছবিটা ধরা পড়বে কি না, সম্মেলন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেও তা নিয়ে সংশয় ছিল। তবে সংশয় কাটিয়ে ‘এক পথিবী’ এবং ‘এক পরিবারে’র জন্য ‘এক ভবিষ্যত’ গড়ার লক্ষ্যে একমত হল সদস্য দেশগুলি। সাফল্যের ঝুলি যে এ ভাবে ভরবে, তা বোধ হয় প্রত্যাশিত ছিল না নয়াদিল্লির কাছেও। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে দ্বিমেরুকৃত বিশ্বে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে সক্ষম হল ভারত।
শনিবার বৈঠকের প্রথম দিনেই নয়াদিল্লির আনা ঘোষণাপত্রে সিলমোহর দিয়েছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলি। এই সাফল্যকে ‘ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী’ বলে বর্ণনা করেছে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সার্বিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার খবরটি ঘোষণা করে বলেন, “আমি ভাল খবর পেয়েছি। আমাদের টিমের কঠিন পরিশ্রমের ফলে নয়াদিল্লির জি২০ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে।” সাফল্যের জন্য এই সম্মেলনে ভারতের শেরপা অমিতাভ কান্ত, মন্ত্রী এবং অন্যান্য সহযোগীদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সুস্থায়ী এবং ভারসাম্যযুক্ত উন্নয়নের বিষয়ে এক মত হয়েছে সদস্য দেশগুলি। বহুমুখী এবং বৈষম্যহীন বাণিজ্যের পক্ষেও সওয়াল করা হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মোদীর পুরনো একটি মন্তব্যই একটু অন্য ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, “বর্তমান সময় কোনও ভাবেই যুদ্ধের সময় নয়।” রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, “কোনও রাষ্ট্র ভূখণ্ড বাড়াতে অন্য দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।” তবে রাশিয়ার ‘আগ্রাসন’ নিয়ে যেমন ঘোষণাপত্রে কিছু বলা হয়নি, তেমনই জি৭ গোষ্ঠীগুলির দাবি মেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনও নিন্দা প্রস্তাবও আনা হয়নি।
আপাত ভাবে ভারতের এই ভারসাম্যের কূটনীতি নির্জোট আন্দোলনের সময়কে মনে করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা যুদ্ধের তুলনায় এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। মিল বলতে, তখনকার মতোই আড়াআড়ি ভাবে দু’ভাগে বিভক্ত গোটা বিশ্ব। এক আমেরিকা বাদে এই যুদ্ধের কুশীলবেরাও সময়ের ফেরে বদলে গিয়েছে। সূক্ষ ভাবে হলেও বদল এসেছে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানেও।
২০২১ সালে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে হওয়া সপ্তদশ জি২০ বৈঠকের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘অধিকাংশ সদস্য’ ইউক্রেন যুদ্ধের নিন্দা করছে। এর পাশাপাশি এ-ও বলা হয়েছিল, এই যুদ্ধ নিয়ে সদস্যদের মধ্যে ‘অন্য মত’ও রয়েছে। উল্লেখ্য যে, এত দিন পর্যন্ত আমেরিকা এবং পশ্চিমি দুনিয়ার ধারাবাহিক চাপ সত্ত্বেও রাষ্ট্রপুঞ্জ-সহ কোনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাব সমর্থন করেনি ভারত। মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগও ছিন্ন করেনি। বরং রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমি দেশগুলি অর্থনৈতিক অবরোধ চালিয়ে গেলেও মস্কোর থেকে অশোধিত তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে নয়াদিল্লি। ভারত আগাগোড়াই আলোচনার মাধ্যমে রুশ-ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রী এক বছর আগে উজবেকিস্তানে শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর বৈঠকে প্রকাশ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলেছিলেন, ‘‘এখন যুদ্ধের সময় নয়।’’ দিল্লি ঘোষণাপত্রেও প্রায় একই কথার পুনরুচ্চারণ করে বলা হয়েছে, “বর্তমান সময় কোনও ভাবেই যুদ্ধের সময় নয়।”
এ বারের জি২০ সম্মেলনে সদস্য দেশগুলি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছল, তা নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা আসতে শুরু করে দিয়েছে। রাশিয়ার বক্তব্য, এই সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাপত্রে ‘ভারসাম্যের প্রতিফলন’ই দেখা গিয়েছে। আবার ফ্রান্সের বক্তব্য, বৈঠকের উপসিদ্ধান্তে রাশিয়াকে ‘কোণঠাসা’ করা গিয়েছে। কিন্তু অনেকেরই মত, আয়োজক দেশ হিসাবে নিজের ভারসাম্যের কূটনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে ভারত। জি২০ বৈঠকেই ভারত থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ পর্যন্ত একটি অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, চিনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবেই এই প্রস্তাব নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। পশ্চিমি দুনিয়ার প্রায় সব দেশই এই অর্থনৈতিক করিডর তৈরির প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়েছে।
বৈঠক শুরুর আগে থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের একাধিক সিদ্ধান্তের নেপথ্যে আমেরিকার হাতযশ দেখছেন অনেকেই। লাদাখের সীমান্ত সংঘাত নিয়ে চিন যেমন ভারতের মাথাব্যথা, তেমনই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের ‘আগ্রাসন’ নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে ওয়াশিংটনেরও। তা ছাড়া একাধিক আন্তর্জাতিক মঞ্চে রাশিয়া-চিন বোঝাপড়াকেও কড়া নজরে রাখছে বাইডেনের দেশ। ইতিমধ্যেই ২০২৬ সালে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ হিসাবে আমেরিকাকে মেনে নিতে আপত্তি জানিয়েছে চিন। এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতের মতো শক্তিকে আমেরিকার প্রয়োজন। ব্রিকস-এর মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে চিন যাতে নিয়ন্ত্রিত করতে না পারে, সে দিকেও তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে আমেরিকার।
সমুদ্রপথে চিনের আগ্রাসন রুখতে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রিলিয়ার সঙ্গে চতুর্দেশীয় অক্ষ কোয়াডে যোগ দিয়েছে ভারত। সূত্রের খবর, ২০২৪ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে বিশেষ উপস্থিত থাকতে পারেন কোয়াড গোষ্ঠীর রাষ্ট্রপ্রধানেরা। তাই নয়া মেরুকৃত বিশ্বে আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক তো বটেই, অন্যান্য নানা ক্ষেত্রেই বোঝাপড়া বাড়াবে ভারত। এই আপাত নিরপেক্ষতার মধ্যে হয়তো আগেকার নির্জোট আন্দোলনের পশ্চিমি বিরোধিতার ছাপ থাকবে না। বরং ঘরে-বাইরের লড়াইয়ে ভারতের জয়ে হয়তো সক্রিয় ভূমিকা নেবে আমেরিকাও। নয়াদিল্লির জি২০ শীর্ষ সম্মেলন হয়তো তারই ইঙ্গিত দিয়ে রাখল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy