চাবাহার সমুদ্রবন্দর, যার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা রেলপ্রকল্পের। -ফাইল ছবি।
চাবাহার প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রেলচুক্তি নিয়ে ভারত এবং ইরানের মধ্যে ডামাডোল চলছে। সাউথ ব্লকের বক্তব্য, বিষয়টি গুরুতর নয়। যথাসময়ে ওই রেলপ্রকল্পে যুক্ত হবে ভারত। অন্য দিকে ইরানের বক্তব্য, ভারত টাকা দিতে দেরি করছে। তাই নিজেদের অর্থেই প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়েছে তারা।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরানের সঙ্গে রেলপ্রকল্প নিয়ে চলতি বিতর্ক হয়তো শীঘ্রই মিটে যাবে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে চিনের নতুন বন্ধুত্ব নিয়ে যে বহুমাত্রিক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা সহজে মেটার নয়। ভারতের তেহরান-নীতিকে কী ভাবে নতুন করে সাজানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনাও চলছে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। যদিও একই সঙ্গে সাউথ ব্লক সূত্রে বলা হচ্ছে, ইরান প্রশ্নে আমেরিকার রণংদেহি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত তেহরান-প্রেম দেখানো খুব সহজ হবে না নয়াদিল্লির পক্ষে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি-র স্লোগান ছিল—'পূর্ব নয়, পশ্চিমও না!‘ কিন্তু কূটনীতিকদের একাংশের মতে, সেই স্লোগান আজকের ইরানের জন্য সত্য নয়। সূত্রের খবর, ২০১৬ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং তেহরান গিয়ে একটি মহাচুক্তি সেরেছেন। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনও ঘোষণা না হলেও সূত্রের দাবি, পঁচিশ বছরের এই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আর্থিক মূল্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ইরানের মূল পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র, ব্যাঙ্কিং, টেলিকম, রেল, মেট্রো, বন্দর, বিমানবন্দর-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এ বার হইহই করে ঢুকে যাবে চিন। বিনিময়ে চিন এবং
ইউরোপের মধ্যে সংযোগের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে ইরান। হয়ে উঠবে চিনের মহাযোগাযোগ প্রকল্প ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’-এর অন্যতম অংশীদারও। পাশাপাশি যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র উৎপাদনেও সামিল হবে চিন এবং ইরান। এর কোনওটাই সাউথ ব্লকের জন্য ভাল খবর নয়।
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে এসে তাদের উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরে ইরানের অর্থনৈতিক লাইফলাইনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় আমেরিকা-ইজরায়েল অক্ষ সামলাতে দরকার ছিল আন্তর্জাতিক সহযোগিতারও। আর এই ক্ষেত্রে ভারত নয়, বন্ধুর বেশে ঢুকে পড়েছে শি চিনফিং সরকার। ভারত বরং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জেরে ধাপে ধাপে শূন্যে নিয়ে এসেছে সে দেশ থেকে তেল আমদানি। তবে এটাও ঠিক যে, মজলিশে (ইরানি সংসদ) তেহরানের বর্তমান সরকারের এই চিন-প্রীতিকে ভাল চোখে দেখছেন না অনেকেই। সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহমৌদ আহমেদিনেজাদ থেকে শুরু করে ইরানের ক্ষমতাচ্যূত রাজতন্ত্রের উত্তরসূরি রেজা পাহলভী— সবাই চিনের সঙ্গে ওই পঁচিশ বছরের চুক্তির বিরোধিতা করছেন। উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চিন সরকারের নির্মম ব্যবহারের কথাও মাথায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। তবে এই বিরোধিতায় ইরান সরকারের সিদ্ধান্ত বদলের কোনও সম্ভাবনা অন্তত এখনই দেখা যাচ্ছে না।
দিল্লির কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, মজলিশের ওই দুর্বল বিরোধিতার জন্য বসে না থেকে অবিলম্বে ভারতের তেল আমদানির বৃহত্তম উৎস (মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আগে পর্যন্ত) ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। নচেৎ ইরানকে কাজে লাগিয়ে মধ্য এশিয়া তথা পূর্ব ইউরোপে পৌঁছনোর যে পরিকল্পনা ভারত করেছে, তা ব্যর্থ হবে। চিনের সক্রিয় প্রয়াসে ইরান-পাকিস্তান দীর্ঘদিনের মতবিরোধ কমতে পারে। সেটাও ভারতের জন্য ভাল খবর নয়। ইরানের বন্দর এবং রেলে চিনের বিনিয়োগের ফলে ভারতীয় পণ্য মধ্য এশিয়ার পৌঁছনোর প্রশ্নে সংশয় তৈরি হবে। চাবাহার বন্দরের পরিচালনভার চিন না পেলেও গোটা প্রকল্প ঘিরে যাবতীয় পরিকাঠামো তাদের হাতে চলে গেলে এই বন্দরে এত দিন ধরে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ ভারতের জন্য অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে বলেও আশঙ্কা সাউথ ব্লকের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy