Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
India-China

চিন বয়কট বলছি তো খুব, কিন্তু নিজেরা করলামটা কী?

প্রধানমন্ত্রী তাঁর গদিতে বসেই স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ নয়!

সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের নিয়ে হাসছি আমরাই। ঠাট্টা করে বলছে, চিনা পণ্য বয়কটের টিশার্ট-টুপিও নাকি তৈরি করে পাঠাচ্ছে চিন। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের নিয়ে হাসছি আমরাই। ঠাট্টা করে বলছে, চিনা পণ্য বয়কটের টিশার্ট-টুপিও নাকি তৈরি করে পাঠাচ্ছে চিন। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।

সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২০ ২০:৩০
Share: Save:

চিনকে চিনতে ভুল করেছি? না, আয়নায় নিজের মুখই দেখতে চাইনি! তলিয়ে দেখলে কিন্তু বারেই বারেই দোষটা নিজেদের ঘাড়েই বর্তায়। তবে যে সাহস থাকলে আগে নিজেদের মুখ দেখা যায়, সেই সাহসটা আমাদের আছে কি? তথ্য বলে, ‘না’।

আইকিয়া। আমরা অনেকেই এই বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে আসবাবের ব্যবসা করা সুইডিশ সংস্থার নাম জানি। এদের খ্যাতির কারণটা নিয়ে কি ভাবি? কম জায়গায় ব্যবহার করা যায় এমন আসবাব তৈরি করেই বিশ্বের বাজার ধরেছে সংস্থাটি। কিন্তু করব ভাবলেই কি করা যায়? আইকিয়া পেরেছে তার কারণ, সাধারণের চাহিদা বুঝে আসবাবের ডিজাইন করতে আয়ের একটা বড় অংশ খরচ করে চলেছে সংস্থাটি। আর তাই, ২০০৮ সাল থেকে অন্যতম বৃহত্তম আসবাব সংস্থা হিসাবে বিশ্ব বাজারে জাঁকিয়ে নিজের জায়গা ধরে রেখেছে আইকিয়া।

কয়েক বছর আগে ভারতের বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের রাজা বলে পরিচিত সরোজ পোদ্দারের সঙ্গে একটি প্রতিবেদনের জন্য তাঁর কলকাতা অফিসে কথা বলছিলাম। আমরা আজ ব্রান্ডেড পণ্য ব্যবহার করে বুঝে গিয়েছি, ভারতে তৈরি আপনার আমার দৈনন্দিন ব্যবহারের একটা সামান্য অংশই গুণগত মানে বিশ্বের বাজারে পাত পাবে। উনি কিন্তু এটা বুঝেই লাইসেন্স রাজের জামানাতেই জিলেটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারতে দাড়ি কামানোর ব্লেড তৈরি শুরু করেন। সেই সময় যে সব ব্লেড চলত, সেই সব ব্র্যান্ডের অনেক ব্লেডই এখনও আছে, কিন্তু সেগুলি দাড়ি কাটতে কতটা ব্যবহার হয় তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে হ্যাঁ, ডাক্তারখানায় স্টিচ কাটতে দেশি ব্লেডের ব্যবহার হয়, তা কিন্তু আমরা নিত্যই দেখে থাকি।

সরোজবাবুর কথায়, “দেশে তৈরি যা আমরা রোজ ব্যবহার করি, তার গুণগত মান নিয়ে কোনও দিনই আমরা মাথা ঘামাইনি। কারণ ভালটা কী তাই আমরা জানতাম না। বিদেশ যাঁরা যেতেন তাঁরা নিত্য ব্যবহারের ছুরি-কাঁচি কিনে আনতেন। যে দিশি ব্লেডে দাড়ি কামাতাম তাতে গাল যত কাটত, দাড়ি তত ভাল কাটত না। তাই আমি এই বাজারে নজর দিই। আর প্রথম লক্ষ্য হয় জিলেটের ব্লেড!”

আরও পড়ুন: যে যুদ্ধ থেকে শিখতে পারি

আজ এই চিন নিয়ে চিলচিৎকারের মাঝে যে সত্যটা আমরা ভুলে যাচ্ছি, তা হল— ভারতের বেশির ভাগ উৎপাদক সংস্থাই কিন্তু পণ্যের গুণগত মানের থেকে লাভের অংশতেই অনেক বেশি নজর দিয়ে থাকেন। সরোজবাবু এটা বুঝেই হাত বাড়িয়েছিলেন জিলেটের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে। তিনি জানতেন, বিশ্বমানের ব্লেড বানাতে যে টাকা তাঁকে প্রযুক্তি তৈরিতে খরচ করতে হবে, তা তাঁর অধরা। তাই যার আছে তার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা সহজ। তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

ভাবছেন, আইকিয়া আর সরোজ পোদ্দারের মিলটা কোথায়? একটা জায়গাতেই। দুজনেরই লক্ষ্য, চাহিদা বুঝে গুণগত মান ঠিক করে সাধারণের ঘরে পৌঁছনোর। কিন্তু তা করতে গেলে প্রয়োজন গবেষণায় খরচ করা। জিলেট বছরে ২০০ কোটি ডলার খরচ করে গবেষণায়। ডলার পিছু ৭৫.৯৯ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ১৫ লক্ষ কোটি টাকার উপরে। আর ওই সব জায়গা বাঁচানোর আসবাব তৈরির গবেষণায় আইকিয়া বছরে খরচ করে ৩৮০ মিলিয়ন বা ৩৮ কোটি ইউরো! ইউরো পিছু ৮৫.১৮ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার উপরে!

আরও পড়ুন: মেক ইন ইন্ডিয়া: কিন্তু বানাবেই বা কে, আর কিনবেই বা কে

আসি দেশের কথায়। আমাদের গোটা দেশের এই জাতীয় গবেষণায় খরচ জিডিপি-র ০.৭ শতাংশ ছিল ২০১৭ সালের আশেপাশে। ব্রুকলিন ইন্ডিয়ার সমীক্ষা মেনে চললে, সেই বছর জাতীয় উৎপাদন যদি ২০০ লক্ষ কোটি টাকা হয়ে থাকে, তা হলে আমরা এই জাতীয় গবেষণায় খরচ করেছি ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো গোটা দেশ জুড়ে। জিলেটের গবেষণার খরচ ভুলে যান। আমাদের গোটা দেশে আইকিয়ার কত গুণ পণ্য-গবেষণায় খরচ করা হয় তা দেখতে ক্যালকুলেটর লাগে না।

আসলে আমরা লোভী। আর আমাদের লোভ আমাদের নাকের বাইরে দেখতে দেয় না। উৎপাদন শিল্পে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দরকার পণ্য নিয়ে গবেষণার, প্রয়োজন বাজারের চাহিদা বোঝার। অতি সাধারণ ঘর মোছার জিনিসও আজ বদলে গিয়েছে গবেষণার কল্যাণেই। কাচ মোছার ডান্ডা-ঝাড়ু, যা একই সঙ্গে সাবান ঢালতে পারে আর পরিষ্কার করতে পারে, তাও কিন্তু গবেষণারই ফসল। আর এই গবেষণাতেই আমরা অলস। জিডিপি-র হিসাবে একটা তথ্য দেখলাম। এ বার দেখে নিই পেটেন্টের হিসাব। ব্রুকলিনের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী— ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লক্ষ পেটেন্ট দেওয়া হয়েছিল। চিনে তার থেকে দ্বিগুণ। আর আমাদের দেশে এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ৪৬ হাজার ৪০০!

আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর গদিতে বসেই স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’। ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ নয়! ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ হলে ব্র্যান্ড তৈরির একটা দায় থাকে। কারণ এর মানে গিয়ে দাঁড়ায় ‘ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া’। গাড়ি যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা অনেকেই বলেন, ‘গাড়ি চড়লে ইউরোপ বা আমেরিকায় তৈরি গাড়ি চড়ব।’ যেমন, মার্সিডিজ। অর্থাৎ এই সব অঞ্চলে তৈরি গাড়ি একটা ন্যূনতম গুণগত মানের কথা ধরেই নেওয়া হয়। তাই এটা হয়ে যায় ‘ব্র্যান্ড ইউরোপ’। আর এই ব্র্যান্ড তৈরি করতে কিন্তু প্রতিটি উৎপাদককে তার পণ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এটা কিন্তু তখনই সম্ভব, যখন উৎপাদক এই মান বজায় রাখতে গবেষণায় তার লাভের টাকার একটা বড় অংশ ঢালাটা অভ্যাসের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন জিলেট, যেমন আইকিয়া। অথবা অন্যান্য সংস্থা।

এই আলোচনা চিনের সঙ্গে তুলনার নয়। এই আলোচনা আমাদের উৎপাদন শিল্পের গুণমান বিমুখতার। বিজেপি সরকারের কেন্দ্রে আসার অনেক আগেই কিন্তু সরকারি স্তরে এই বোধটা ছিল। তাই ইউপিএ সরকার ২০০৭ সালে জাতীয় ডিজাইন নীতি ঘোষণা করে। কারণ দেশের সংস্থারা যদি পণ্য ডিজাইন ও গবেষণায় খরচ না করে, তা হলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। আর এর পর পরই ২০১১ সালে তৈরি হয় জাতীয় উৎপাদন নীতি, যার লক্ষ্যই ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় উৎপাদনের ২৫ শতাংশই যাতে উৎপাদন শিল্প থেকে আসে তা দেখা। বিজেপি সরকারও কিন্তু ইউপিএ-র লক্ষ্য ধরেই এগোচ্ছে। ফারাক হল— প্রাক্তন সরকারের যেটা প্রাপ্য সেটা অস্বীকার করেই, সেই নীতিকেই আত্মীকৃত করে। তাই এই সরকারও ২০২৫ সালের মধ্যেই উৎপাদন শিল্পের জন্য একই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। জিডিপিতে উৎপাদন শিল্পের ২৫ শতাংশ অবদানের।

অর্থাৎ, বর্তমান সরকার যাকে স্লোগান করেছে, সেই নীতি কিন্তু তৈরি হয়েছে এই সরকার আসার আগেই। আর এই দুই নীতির একযোগে লক্ষ্যই ছিল দেশে তৈরি পণ্যের যৌথ ব্র্যান্ড গড়ে তোলা— ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। উল্টো দিকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মূল লক্ষ্যই হচ্ছে যে কেউ এসে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করুন। তাতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়বে, হয়ত বাড়বে আয়। কিন্তু চিন ১৯৯০ সাল থেকে যে ভাবে নিজের ঘাঁটি বাজারে গেড়েছে, তেমনটি পারব কি? এই লক্ষ্যেই তো এত দিন ধরে আমরা চিনকে ভোলানোর চেষ্টা করেছি, চিনের আর্থিক সাম্রাজ্যবাদের পরিচিতি ভুলে গিয়েই। আজ চিনের কাছে থাপ্পড় খেয়ে চৈনিক পণ্য বর্জনের কথা বলছি। তবুও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-কে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ না করে, পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকার সহজ পথটাই বেছে নিচ্ছি। এই নীতি একজন ব্যবসায়ী নিতে পারেন। যেমন সরোজ পোদ্দার নিয়েছেন। কিন্তু গোটা দেশ সেটা নিলে কি আমরা কোনও দিন সত্যিই বিশ্বের অন্যতম আর্থিক শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারব? কেউ পারেনি। ব্র্যান্ড ইন্ডিয়া না হয়ে ভারত কী ভাবে ব্যতিক্রম হবে বাজার দখলের যুদ্ধে? স্লোগান যাই হোক না কেন, উত্তরটা নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকরা জানেন। আমরা জানতে পারছি না, এই যা।

অন্য বিষয়গুলি:

India-China Galwan Valley Ladakh India China Border Make in India Boycott China IKEA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy