এলএসি বরাবর দ্রুত সৈন্যসংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। তবে উচ্চতা যত বেশি, সদ্য পৌঁছনো বাহিনীর খাপ খাওয়াতেও সময় লাগবে ততটাই বেশি।—ছবি এপি।
এই সঙ্ঘাত কিন্তু সহজে প্রশমিত হবে না। সীমান্তে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তাতে প্রশমনের কোনও লক্ষণ নেই। নানা স্তরে আলোচনা চলছে ঠিকই, কিন্তু সোমবার রাতে গলওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর থেকে কোনও আলোচনাই এখনও পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে দু’পক্ষই। লাদাখ থেকে অরুণাচল পর্যন্ত প্রায় গোটা এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা) জুড়ে সৈন্য সমাবেশ বাড়ছে দু’দিকেই। সঙ্ঘাত যদি বাড়ার হয়, তা হলে বাড়তে আর খুব দেরি নেই। অপেক্ষা শুধু ‘অ্যাক্লাইমেটাইজেশন’-এর।
কী এই অ্যাক্লাইমেটাইজেশন? এই কথার বাংলা অর্থ হল অভিযোজন বা নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। ভারত এবং চিনের সীমান্ত যে এলাকার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু। ওই পরিবেশে চট করে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় না, সময় লাগে। আর সেই নির্দিষ্ট সময় ধরে ওই উচ্চতায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াটাকেই বলা হয় অ্যাক্লাইমেটাইজেশন।
ভারত এবং চিন এখন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাহিনী এনে জড়ো করছে এলএসি-র দু’পাশে। সমতল বা নিচু এলাকা থেকে ওই উচ্চতায় যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁদের পক্ষে সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা কিছুতেই সম্ভব নয়। উচ্চতা এবং পরিবেশের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগবে। সেই সময়টা কাটার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পরিস্থিতির উত্তাপ বাড়তে পারে।
ডোকলামে যখন ভারত-চিন মুখোমুখি হয়েছিল, তখন ৭৩ দিন ধরে টানাপড়েন চলেছিল। এ বার এখনও অতটা সময় কাটেনি। কিন্তু এ বার উত্তেজনা অনেক বেশি, অনেক বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ডোকলামে দুই বাহিনী যত দিন ধরেই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকুক, সশস্ত্র সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। অন্তত আমরা তেমন আঁচ পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি অনেকটাই অন্য রকম। যে ভাবে চিন বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, যে ভাবে কোর কম্যান্ডার স্তরের বৈঠকে হওয়া সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করেছে এবং নিরস্ত্র ভারতীয় বাহিনীর উপরে যে রকম কাঁটাওয়ালা লাঠি ও খুকরি দিয়ে হামলা চালিয়েছে, তাতে ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে আক্রোশ তীব্র। ভারতীয় বাহিনী সে রাতে প্রত্যাঘাত করেনি, এমন নয়। চিনের তরফে হতাহতের সংখ্যা কেমন, সে বিষয়েও নানা খবর আসছে। কিন্তু চিনকে কতটা তীব্র প্রত্যাঘাত সে রাতে করা গেল, তা এখন আর বাহিনীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাহিনী চাইছে বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে। সেই সুযোগ বাহিনীকে সরকার দেবে বলেই আমরা ধারণা।
আরও পড়ুন: সীমান্তে নীতিভঙ্গ করেনি সেনা, রাহুলকে জবাব জয়শঙ্করের
ভারত এবং চিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ বাধতে চলেছে, এমন কথা আমি বলছি না। কিন্তু সামরিক ভাষায় চিনকে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি যে চলছে, তা এখন গোপন নয়। এলএসি-তে সৈন্য সমাবেশ যে দ্রুত বাড়ছে, সে খবর সব সংবাদমাধ্যমের কাছেই রয়েছে। এই সৈন্য সমাবেশ কেউ অকারণে করে না। চিনও এলএসির ও পারে সেনা বাড়াচ্ছে, সুতরাং ভারতকেও সেনা বাড়াতেই হবে, আত্মরক্ষার জন্যই বাড়াতে হবে— এই তত্ত্ব ঠিক। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আত্মরক্ষার জন্য বা প্রতিপক্ষের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট বাহিনী বা সরঞ্জাম সারা বছরই মোতায়েন থাকে সীমান্তে। তাই নীতি যদি শুধুমাত্র রক্ষণাত্মক হয়, তা হলে এতটা সৈন্য সমাবেশের প্রয়োজন হয় না। সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা যে ভাবে দ্রুত বাড়াচ্ছে ভারত, যে ভাবে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম এবং রসদ বাড়ানো হচ্ছে, তা বড়সড় প্রস্তুতির ইঙ্গিতই দেয়।
বাহিনী চাইছে বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিতে। সেই সুযোগ বাহিনীকে সরকার দেবে বলেই ধারণা।—ছবি এপি।
এই প্রস্তুতি এবং এই সামরিক তৎপরতা কিন্তু অত্যন্ত জরুরি ছিল। আমি আবার বলছি, বাহিনীর মধ্যে আক্রোশ এখন তীব্র। গলওয়ানের ঘটনার জবাব দিতে আন্তর্জাতিক মহলে নানা কূটনৈতিক লড়াই ভারত শুরু করেছে। অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ভাবে চিনকে ধাক্কা দেওয়ার তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাহিনীতে দীর্ঘ দিন থাকা এবং একাধিক পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সাক্ষী থাকার সুবাদে আমি বলতে পারি, বাহিনী এখন সামরিক ভাবেও প্রতিকার চায়। যদিও বাহিনী কী চাইল, কী চাইল না, তার উপরে দাঁড়িয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় না। আর সরকারের সিদ্ধান্ত মানতে যে কোনও সুশৃঙ্খল বাহিনী বাধ্য। কিন্তু গলওয়ানের হামলার পরে যে ভাবে তিন বাহিনীকেই যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার সঙ্কেত দিয়েছে দিল্লি, তাতে আমার মনে হচ্ছে, বাহিনীর ইচ্ছাকে সরকার মর্যাদা দিতে চায়।
শেষ পর্যন্ত কোন দিকে গড়াতে চলেছে পরিস্থতি, তা স্পষ্ট হতে কিন্তু খুব সময় লাগবে না। সীমিত পরিসরেই হোক বা বৃহত্তর, চিনকে সামরিক জবাব যদি দিতেই হয়, তা হলে খুব তাড়াতাড়িই তা দেওয়া হবে। চিন এখন চাইছে সঙ্ঘাতে ইতি টানতে। মুখে অন্তত বার বার তেমনই বলছেন বেজিঙের মুখপাত্রেরা। মুখে এক কথা বলতে বলতে কাজে ঠিক উল্টোটা করা চিনের বরাবরের স্বভাব। তাই ফের বিশ্বাসঘাতকতা হতে পারে, এমনটা ভারত ধরেই নিচ্ছে। তার মোকাবিলার প্রস্তুতিও রাখছে। কিন্তু যে বিশ্বাসঘাতকতা সোমবার রাতে হয়েছে, তার জবাবটাও ভারতীয় বাহিনী দ্রুত দিতে চাইছে। দ্রুত জবাব দেওয়াটা জরুরিও। কারণ এই সব পরিস্থিতিতে বেশি সময় কেটে যেতে দেওয়া যায় না। অনেক দিন কেটে যাওয়ার পরে প্রত্যাঘাত করলে সে প্রত্যাঘাত অত তাৎপর্যপূর্ণ হয় না। সুতরাং চিনের সামরিক প্রশ্নের উত্তর সামরিক ভাষায় যদি আমাদের বাহিনী দেয়, তা হলে খুব দ্রুতই তা দেবে বলে আশা করছি। অপেক্ষা শুধু খাপ খাইয়ে নেওয়ার।
আরও পড়ুন: ভারত-চিন সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দু গলওয়ান উপত্যকার নামের সঙ্গে জড়িয়ে কোন ইতিহাস?
সীমান্তে যে বাহিনী সারা বছর মোতায়েন থাকে, সেই বাহিনীর লক্ষ্য কিন্তু রক্ষণাত্মক। অর্থাৎ দেশের সীমান্তকে রক্ষা করা, প্রতিপক্ষের অসাধু কার্যকলাপ রুখে দেওয়া। আর ভারত এখন যে রকম পদক্ষেপের কথা ভাবছে, তা কিন্তু আক্রমণাত্মক। অর্থাৎ গলওয়ান উপত্যকা আর ফিঙ্গার-৪ এলাকা ছেড়ে চিনা বাহিনী যদি পিছু হঠতে রাজি না হয়, তা হলে অন্য বেশ কিছু এলাকায় পাল্টা আগ্রাসন দেখানো। লাদাখ থেকে অরুণাচলের মধ্যে এমন অনেক এলাকা রয়েছে, যে সব এলাকা ভৌগোলিক ভাবে ভারতের জন্য অনেক বেশি সুবিধাজনক। চিন ওই সব এলাকায় প্রতিকূল অবস্থানে রয়েছে। সেই সব সেক্টরেই আক্রমণাত্মক (অফেন্সিভ) পদক্ষেপ ভারত করতে পারে বলে আমার মনে হয়। অর্থাৎ সোজা কথায় বললে— তুমি যদি আমার জমি ছেড়ে নড়তে রাজি না হও, তা হলে তোমার পাঁচিল যেখানে দুর্বল, আমি সেখানে ঘা মারব, তোমার এলাকায় ঢুকব এবং কব্জা করে বসে থাকব।
গলওয়ানের ঘটনার পর বাহিনীর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে চাইছে সরকার।—ছবি এপি।
প্রশ্ন হল, এই পদক্ষেপটা করতে কত দিন সময় লাগবে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমি প্রথমেই বলব, এটা কিন্তু পর্যটন নয়। পর্যটকরা হালকা ঘোরাফেরা করে ফিরে আসেন, তাতেই অনেকের মধ্যে অসুস্থতা বা দুর্বলতা দেখা দেয়। জওয়ানদের ক্ষেত্রে কাজটা কিন্তু অনেক বেশি কঠিন। যুদ্ধ করার জন্য সর্বোচ্চ শারীরিক সক্ষমতা জরুরি। তাই আচমকা ওই উঁচু পাহাড়ে উঠেই যুদ্ধ করা যায় না। পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ধীরে ধীরে পূর্ণ শারীরিক সক্ষমতায় পৌঁছতে হয়। জওয়ানদের সেই কারণেই অ্যাক্লাইমেটাইজ করতে হচ্ছে।
কতটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাহিনীকে, তার উপরে নির্ভর করে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময়সীমা। ৯ হাজার ফুটের উপরে যদি নিয়ে যাওয়া হয় বাহিনীকে, তা হলে খাপ খাইয়ে নিতে ৭ দিন সময় লাগে। ১১ হাজার ফুটের উপরে গেলে প্রয়োজন হয় আরও ৭ দিন, অর্থাৎ ১৪ দিন। আর যদি ১৩ হাজার ফুট বা তারও বেশি উচ্চতায় যুদ্ধ করতে হয়, তা হলে অন্তত ২১ দিন গেলে যায় অ্যাক্লাইমেটাইজেশনে।
অরুণাচলের যে চিন সীমান্তবর্তী এলাকা, সেখানকার কোনও কোনও সেক্টরে উচ্চতা কম। তাওয়াং-এর উচ্চতা ৯ হাজার ফুটের কম। বমডিলার উচ্চতা ৮ হাজারের কম। মেচুকা মাত্র হাজার চারেক ফুট। ওই সব এলাকায় খাপ খাইয়ে নেওয়ার দরকার হচ্ছে না। কিন্তু সেলা পাস ১৩ হাজার ৬৮০ ফুট উঁচুতে। ফলে ওই এলাকায় মানিয়ে নিতে অন্তত ২১ দিন লাগবে নতুন পৌঁছনো বাহিনীর।
আরও পড়ুন: বিনিয়োগ থেকে পণ্য— অবাধ বিচরণ, চিনকে বয়কট করা কঠিন, বলছে সমীক্ষা
লাদাখের দৌলত বেগ ওল্ডি এলাকার উচ্চতা প্রায় ১৭ হাজার ফুট। সিকিমের নাথু লা সেক্টর ১৪ হাজার ফুটেরও বেশি উঁচুতে। এই সব এলাকাতেও অ্যাক্লাইমেটাইজেশনের জন্য ২১ দিন করে সময় লেগে যেতে পারে। উত্তরাখণ্ডের কিছু এলাকায় অবশ্য সময় কিছুটা কম লাগবে। মানা গ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ভারতের জন্য, কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানেও সেনা সমাবেশ হচেছে। তবে ওই এলাকার গড় উচ্চতা সাড়ে ১০ হাজার ফুটের মতো। তাই খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এক সপ্তাহের বেশি সময় সেখানে লাগবে বাহিনীর।
মোট কথা, নতুন করে মোতায়েন হওয়া বাহিনী খাপ খাইয়ে নিলেই প্রস্তুতি সারা। তার পরে যে কোনও মুহূর্তে চিনের সঙ্গে সামরিক ভাষায় কথা বলতে পারে ভারত। চিন পাল্টা প্রস্তুতি নিচ্ছে না, এমন নয়। তারাও জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারত কী করতে পারে, কী পারে না, সে সব লালফৌজও বিচার-বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু নানা রকম বিচার-বিশ্লেষণ করেও সব সময়ে সব কিছু আটকানো যায় না। ভূপ্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক কারণে যে সব এলাকায় চিন দুর্বল, সেখানে ভারত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে ঠেকানো খুব শক্ত হবে চিনের পক্ষে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy