পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
তখন সদ্য সরোজিনী নগর তার যাপন শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা আগন্তুকদের বাঁচার লড়াইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সস্তায় তরি-তরকারি আর ছিটকাপড় বিক্রি করে আজকের ধনী দিল্লিবাসীর পূর্ব প্রজন্মের নির্বাহ শুরু। স্বাধীনতার তখনও শৈশব কাটেনি। শাহি দিল্লির সুখা বাতাসে মিশতে শুরু করেছে সদ্য দেশ ছেড়ে আসার হেমারেজ।
“রাজপথ জুড়ে সকাল ন’টা থেকেই সাইকেলের মিছিল। সাউথ ব্লক নর্থ ব্লকে আপিস করতে চলেছেন বাবুরা। কী সুন্দর যে সেই সারিবদ্ধ সাইকেল চলার ছবি। প্যান্টে পিন এঁটে সবাই প্যাডল করছেন বেতের বাস্কেট লাগানো সাইকেলে। সেই ঝুড়িতে দিনের টিফিন, অনেক সময়ে বাড়তি কাপড়চোপড়ও!”
স্মৃতির মায়াগলিতে উল্টোপথে হেঁটে পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় পৌঁছে গিয়েছেন পঞ্চাশের দশকের দিল্লিতে। ৯৩ বছর বয়স্ক এই সিআরপার্কের বাসিন্দার স্মৃতিতে কোনও ধুলো নেই আজও। যদিও সাতচল্লিশের পনেরোই অগস্ট তাঁর কাছে পতাকা তোলার বাইরে আর কোনও দ্যোতনা আনে না। তখন তো তাঁরা সপরিবার ফরিদপুর। বাবা ছিলেন সেখানকার একটি স্কুলের হেডমাস্টার। বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে কলকাতায় এ বাড়ি ও বাড়ি ভাইবোনেদের নিয়ে জীবনসংগ্রাম ৪৮ সাল থেকেই। ইউপিএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ছাপান্ন থেকে পরিতোষবাবু পাকাপাকি দিল্লি। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দফতরে।
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি হয়েছিল সেনা ছাউনি, যেখানে পরপর ছিল কটেজ। স্বাধীনতার পরে সেই টানা লম্বা ব্যারাকই হল তথ্য মন্ত্রকের অফিস। এখন সেখানে শাস্ত্রীভবন, কৃষি ভবন তৈরি হয়েছে।” এ দিক-ও দিক ধু ধু মাঠ। উঁচুনিচু জমির মধ্যে লু আছাড়িপিছাড়ি খেত গ্রীষ্মে। বালুর ঝড়ে পাতা ঘুরত গোল হয়ে। পরিতোষবাবুর স্মৃতিচারণ, “গ্রীষ্মকালে খসখসে ঢাকা থাকত অফিস। তাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল ছিটোনোর জন্য লোক ভাড়া করে রাখা হত। ভিতরটা মোলায়েম ঠান্ডা অন্ধকার হয়ে থাকত। কাজের সময়ে আলো জ্বালিয়ে নেওয়া।”
তথ্য মন্ত্রকে কাজ করার দরুন নয়াদিল্লির প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করতে হত পরিতোষবাবুকে। নতুন তৈরি হওয়া বিজ্ঞান ভবনের কমিটি রুমে হত সাংবাদিক সম্মেলন। পরিতোষবাবু বলছেন, “সদ্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিদেশের কোনও সাংবাদিক খোঁচা মারলেন বিহারের তৎকালীন খরা নিয়ে। টকটকে লাল মুখে ইন্দিরা যা উত্তর দিয়েছিলেন এখনও মনে আছে। বলেছিলেন, ‘‘লাইফ ইজ় নট জাস্ট জাম্পিং ফ্রম আ পিক টু আনাদার পিক! মাঝে পতনকাল অনিবার্য, তখন আবার উপরে ওঠার জন্য প্রস্তুত হতে হয়!”
ভেস্পা এবং ল্যামব্রেটা স্কুটার তখন স্বাধীন ভারতের রাস্তায় উদিত হয়েছে এবং সেটি কিনতে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই আবেদন করতে হত অনেক আগে। কিন্তু সাংবাদিকদের জন্য কোটা রাখা হয়েছিল। পরিতোষবাবু সেটার দেখাশোনা করতেন, সাংবাদিকদের কাছে স্কুটার পৌঁছে দেওয়ার কাজটি তাঁর ছিল। ফলে যাঁরা পেতেন তাঁরা এসে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে যেতেন।
এ রকম একটা সময়ে জওহরলালের খুবই ঘনিষ্ঠ সাংসদ এবং তৎকালীন পুর্নবাসন মন্ত্রী মেহেরচাঁদ খন্না সংসদে প্রস্তাব আনলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দিল্লিতে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের জন্য দিল্লিতে একটি কলোনি গড়া হবে। যাঁরা ‘গেনফুলি এমপ্লয়েড’ তাঁদেরই দেওয়া হবে। অর্থাৎ চুরি-ডাকাতি করে টাকা করেছে এমন ব্যক্তিদের নয়। জমি দেওয়া হবে না-লাভ না-ক্ষতি নীতিতে।
“এই সংবাদে আনন্দের ঢেউ। আমি থাকতাম তখন গোলমার্কেটে অনঙ্গ বোসের মেসে। বাঙালিদের মধ্যে তখন এই মেসের রমরমা। অনঙ্গবাবু গর্ব করে বলতেন, এখানকার ভাত না খেলে নাকি দিল্লিতে চাকরি পাকা হয় না! সেখানে থেকে চাকরিতে উন্নতি করার পড়াশোনায় অসুবিধা হওয়ায়, চলে এলাম লোধি রোডে দাদুর মেসে। সপ্তাহে এক বার করে ৪৩০ নম্বর বাসে চড়ে চলে যেতাম কালকাজি। তার কাছেই ইপিডিপি অর্থাৎ ‘ইস্ট পাকিস্তানি ডিসপ্লেসড পার্সন’-এর জন্য নির্ধারিত জমি। গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম চারদিকে ঘন শরবন! তার মধ্যে সিমেন্টের পাইপ ছত্রাকার করে রাখা। সাপ খোপ, বেজির আখড়া। শেয়ালের ডাক। সন্ধ্যায় জোনাকি জ্বলে। ওখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখতাম এক স্থায়ী বাসস্থানের, যা ফরিদপুরের পর হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে।”
হারানো দিনের কথা একটানা বলে যেতে কোনও কষ্ট নেই ৯৩ বছরের এই মানুষটির। আজ যাকে দিল্লি তথা দেশের বাঙালি চিত্তরঞ্জন পার্ক বলে চেনে তার নামকরণ নিয়ে ভোটাভুটি হয়েছিল সংশ্লিষ্ট কমিটিতে। অধিকাংশের ইচ্ছা ছিল নাম হোক পূর্বাচল পার্ক। কিন্তু চিত্তরঞ্জনপন্থীরা খোদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে থেকে পাশ করিয়ে আনলেন এই নাম।
সাতচল্লিশের ১৫ অগস্ট পতাকা উড়িয়ে নয়, তার পনেরো বছর পরে ওই জোনাকিজ্বলা শরবনের মধ্যে দাঁড়িয়েই স্বাধীনতার অর্থ প্রথম বার খুঁজে পেয়েছিলেন পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর মতো অনেক ‘দেশ’ ছেড়ে আসা মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy