(ডান দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং (বাঁ দিকে) কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। —ফাইল চিত্র।
মনমোহন সরকারের শেষ বছরে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন, কয়লাখনি বণ্টন, কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে সিএজি-র একের পর এক রিপোর্টে দুর্নীতির অভিযোগ রাজনীতিতে ঝড় তুলে দিয়েছিল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এ বার সেই সিএজি-র রিপোর্টেই প্রশ্নের মুখে মোদী সরকার। একটি-দু’টি নয়। সিএজি-র রিপোর্টে মোদী সরকারের জমানায় আটটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
গত সপ্তাহে সংসদে যখন অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের দিকে গোটা দেশের নজর, সেই সময়েই সিএজি-র একের পর এক রিপোর্ট সংসদে পেশ হয়েছে। তা নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বিরোধীদের তিরের মুখে পড়েছে মোদী সরকার। ‘চুপ্পি তোড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীজি’ স্লোগান তুলে কংগ্রেস দাবি তুলেছে, নরেন্দ্র মোদীকে এ নিয়ে মুখ খুলতে হবে। ঘটনাচক্রে, সিএজি রিপোর্ট আটটি অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে চারটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের দিকে আঙুল তুলেছে। বিরোধীরা সরব হতেই নিতিন গডকড়ীর সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক সিএজি-র রিপোর্টে খামতি রয়েছে দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু মোদী সরকারের অন্দরমহলে প্রশ্ন উঠেছে, এর ফলে কি গডকড়ীর উপরে আলাদা চাপ তৈরি হবে?
কোথায় কোথায় অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে সিএজি?
এক, ভারতমালা প্রকল্পে সড়ক করিডর তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ৩৪ হাজার কিলোমিটার সড়ক তৈরি করতে ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি বরাদ্দ করেছিল। কিন্তু প্রায় ৮ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকায় ২৬ হাজার কিলোমিটার সড়ক তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে।
দুই, দিল্লির দ্বারকা থেকে গুরুগ্রামের মধ্যে দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১৮ কোটি টাকা অনুমোদিত খরচের বদলে প্রতি কিলোমিটারে ২৫০ কোটি টাকা খরচের বরাত দেওয়া হয়েছে।
তিন, ভারতমালা প্রকল্পে বরাত দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই অনিয়ম রয়েছে।
চার, জাতীয় সড়কে টোল আদায়ের নিয়ম ভেঙে যাত্রীদের থেকে ১৫৪ কোটি টাকা টোল আদায় করা হয়েছে।
পাঁচ, আয়ুষ্মান ভারত-প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য প্রকল্পে একটি মোবাইল নম্বরের সঙ্গে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষের নাম যুক্ত করা হয়েছে। মৃতদের নামেও স্বাস্থ্য বিমায় চিকিৎসার অর্থ বরাদ্দ হয়েছে।
ছয়, কেন্দ্রীয় সরকারের স্বদেশ দর্শন প্রকল্পের অধীনে উত্তরপ্রদেশে অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে ঠিকাদারদের প্রায় ২০ কোটি টাকার সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাত, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক তার পেনশন প্রকল্প থেকে ২ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা অন্য প্রকল্পের প্রচারে খরচ করেছে।
আট, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল-এ বিমানের ইঞ্জিনে নকশা, উৎপাদনে খামতির জন্য ১৫৯ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।
ইউপিএ সরকারের আমলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরীওয়াল আজ বলেছেন, ‘‘মোদী সরকার দুর্নীতির ৭৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।’’ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের অভিযোগ, ‘‘বিজেপির দুর্নীতি ও লুট গোটা দেশকে নরকের পথে ঠেলে দিয়েছে।’’ তাঁর বক্তব্য, বিরোধীদের দিকে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার আগে প্রধানমন্ত্রীর আত্মনিরীক্ষা করা উচিত। কারণ ,প্রধানমন্ত্রী নিজে এই সমস্ত কাজে নজরদারি করেছেন। কংগ্রেস মনে করিয়ে দিয়েছে, ভারতমালা প্রকল্পে যাবতীয় অর্থ বরাদ্দ করেছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার আর্থিক বিষয়ক কমিটি। খড়্গের বক্তব্য, ২০২৪-এর ভোটে ইন্ডিয়া জোট তথা ভারত মোদী সরকারের কাছে এর জবাব চাইবে।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবনিকেশের পরীক্ষক— সিএজি (কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল)-এর পদে রয়েছেন গুজরাতের আমলা গিরিশ চন্দ্র মুর্মু। বরাবরই তিনি নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন বলে পরিচিত। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁকে গুজরাত থেকে দিল্লিতে বদলি করে আনা হয়।
কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশের মন্তব্য, ‘‘বিষদাঁত উপড়ে ফেলার পরেও সিএজি মোদী সরকারের চরম দুর্নীতি ও অকর্মণ্যতা ফাঁস করে দিয়েছে। এর পরে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ খুলতেই হবে।’’ তাঁর প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রীর কি নিজের সরকার ও মন্ত্রকের থেকে ব্যাখ্যা চাওয়ার সাহস আছে?
তিরের মুখে আজ কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। মন্ত্রকের বক্তব্য, ওই রাস্তা তৈরির খরচ প্রতি কিলোমিটার ১৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ কোটি টাকায় পৌঁছে গিয়েছে বলাটা ঠিক নয়। বাস্তবে প্রতি কিলোমিটারে ২০৬ কোটি টাকা খরচ বরাদ্দ হয়েছে। এর পুরোটাই ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ বা উড়াল পথ। ৮ লেনের ‘এলিভেটেড’ অংশের জন্য প্রতি কিলোমিটারে ১৫০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। বাকিটা মাটির উপরে ছয় লেনের রাস্তার জন্য। এই ধরনের বিশেষ প্রকল্পে বাড়তি খরচ হয়ই।
জাতীয় সড়ক তৈরিতে কাজের সাফল্যের জন্য নিতিন গডকড়ী বরাবরই প্রশংসিত হন। আবার রাজনৈতিক শিবিরে অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একমাত্র গডকড়ীই নরেন্দ্র মোদীর কথা মুখ বুজে মেনে নেন না। কংগ্রেস নেতারা অনেক বারই গডকড়ীকে আরও সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন সিএজি রিপোর্টে তাঁর মন্ত্রকের বিরুদ্ধে বেশি অভিযোগ ওঠায় প্রশ্ন উঠেছে, মোদী সরকারের অন্দরমহলে কি এর ফলে ক্ষমতার সমীকরণে পরিবর্তন দেখা যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy