নৌকায় যাত্রী পিছু কারও থেকে চাওয়া হচ্ছে ১০, কারও থেকে ১৫ হাজার বা তারও বেশি! কতগুলি ডুব দিতে চান, পরিবারের জন্য কী ভাবে গঙ্গাজল নিয়ে ফিরতে চান, ‘প্যাকেজ’ চলছে তার ভিত্তিতেও। যিনি যত টাকা দিতে রাজি, তাঁকে তত সঙ্গমের মূল জায়গার ‘শুদ্ধ জল’ এনে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। চড়া দর হাঁকা হচ্ছে হোটেল থেকে খাবারের দোকান, যাত্রী পরিবহণে। চার্জিং কিয়স্কে ফোন চার্জ করতেও দিতে হচ্ছে টাকা। ২৬ ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির শেষ স্নানের আগে, যেমন খুশি দর হাঁকার এই প্রবণতা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, বলতে পারছেন না, যাঁরা দর হাঁকছেন, তাঁরাও!
এমনিতেই প্রয়াগরাজের সঙ্গমস্থলের ঘুম নেই মকর সংক্রান্তির আগে থেকে। গত ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া স্নানের জন্য রাতদিন মানুষের ভিড় এই চত্বরে। দিনের যে কোনও সময়ে পথে বেরোলেই দেখা যাচ্ছে, সার দিয়ে মানুষ চলছে স্নানের জন্য। উত্তরপ্রদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, রবিবার পর্যন্ত কুম্ভে প্রায় ৬১ কোটি মানুষ স্নান সেরেছেন। শিবরাত্রি উপলক্ষে শেষ স্নানের দিন পর্যন্ত এই সংখ্যাটা ৬৫ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে সরকার।
শিবরাত্রি কাটানোর জন্য শনিবার কুম্ভে পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সঙ্গমস্থলে পা রেখেই বলেছেন, ‘‘৫০ কোটি মানুষ আসবেন ধরে নিয়ে সমস্ত বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারও প্রায় ১৫ কোটি বেশি মানুষ স্নান সারতে এসেছেন।”
এই ভিড়ের মধ্যেই দেখা হল ভ্যান রিকশা চালকের সঙ্গে দরাদরিতে ব্যস্ত বর্ধমানের সুমন ঘোষ। সুমন বললেন, ‘‘একটা চৌমাথা থেকে উঠেছি, স্নানের স্থল পর্যন্ত, এক কিলোমিটার রাস্তা এগিয়ে দেওয়ার জন্য জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে চেয়েছে।’’ চিৎকার চলতে দেখা গেল মেলার রাস্তায় একটি লরি ঘিরে। বিরক্ত চালক বললেন, ‘‘মেলায় বাঁশ নামিয়ে ফিরছি, লোকজন রাস্তা আটকে, চড়ে বসেছে।’’
সব থেকে বেশি দর হাঁকছেন মোটরবাইক চালকেরা। না রয়েছে তাঁদের বৈধ নম্বর প্লেট, না রুটের বাধা। স্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে এমন বাইক চালকেরা যাত্রী তুলে আনছেন। স্নান করিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কারও থেকে তাঁরা নিচ্ছেন তিন হাজার, কারও থেকে তারও বেশি। প্রথমেই বলা হচ্ছে, ‘‘এক জন হলে হবে না। অন্তত তিন জন নিয়ে যাব।’’ সামান্য দূরত্বের পথ পেরোতেও চাওয়া হচ্ছে পাঁচশো-এক হাজার টাকা। সুধীর নায়ার নামে বছর পঁয়ত্রিশের এক মোটরবাইক চালক বললেন, ‘‘দিন কয়েক আগে কিস্তিতে মোটরবাইক কিনেছি। এক মাসে কিস্তির টাকা মিটে গিয়েছে। কিছু লাভও হাতে রয়েছে।”
স্নানের ঘাটের কাছে ব্যারিকেডের পরে জলের কাছাকাছি দড়ি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, টাকা দিলেই দড়ি পেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ মিলছে। এক নৌকা চালক বললেন, ‘‘তিন নদীর একেবারে মিলনস্থলে নিয়ে যাওয়া হবে। ১০ মিনিট স্নান করতে মাথা পিছু ১২ হাজার টাকা। সেখানকার জল ভরে নিয়ে যাওয়ার জন্য লিটার প্রতি দু’হাজার টাকা।’’
পুলিশ কিছু বলবে না? নৌকা চালকের দাবি, ‘‘সব ঠিক করা আছে।’’ কিন্তু যাঁদের এত টাকা দেওয়ার উপায় নেই? আর এক নৌকা চালকের বক্তব্য, ‘‘সকলের জন্য তো এক দর নয়।’’
ভিআইপি স্নানের জায়গা দিয়ে বেরিয়ে আসার মুখে চোখে পড়ল এক বিশিষ্ট ব্যক্তি পরিবারকে বোঝাচ্ছেন, ‘‘টাকা যায় যাক, ১৪৪ বছরে তো এমন সুযোগ আসবে না! অন্তত আমরা তো ১৪৪ বছর বাঁচব না!’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)