জিত না হার, নির্বাচনী রাজনীতিতে সেটাই শেষ কথা।
ফলে বিহারে ভরাডুবির পরে প্রশ্নের মুখে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রণকৌশল। ঠিক কোনখানে খামতি হল, পরাজয়ের দায় কার,
তা নিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরে কাটাছেঁড়া শুরু হল বলে। কিন্তু মোদী সরকারের দেড় বছরের মাথায় দেশের মানুষের মনে যে অসন্তোষের একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, সেটা বোঝার জন্য কোনও ময়নাতদন্তের প্রয়োজন পড়ে না। দেশের অন্যত্র যে অসন্তোষ অন্তঃসলিলা, বিহার ভোটের ফলাফলে সেটাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।
মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন, তখন তাঁকে ঘিরে ছিল গগনচুম্বী প্রত্যাশা। মনমোহন সিংহের সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব, দুর্নীতি থেকে মূল্যবৃদ্ধি— সব কিছু নিয়েই মানুষ তিতিবিরক্ত ছিলেন। শিল্পমহল থেকে আমজনতা, সকলেরই আশা জেগেছিল, মোদী হয়তো উন্নয়নের মরা গাঙে জোয়ার আনবেন! গুজরাতের মডেল হবে ভারতের মডেল। আঠারো মাসের মাথায় এ দেশের বাস্তবতা কিন্তু সেই প্রত্যাশা থেকে অনেক দূরে।
সুনসান বিজেপি দফতর। বিহারে ফল ঘোষণার পরে। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।
বাজারের হাল শোচনীয়। ভারী শিল্পে নাভিশ্বাস। শেয়ার বাজার আস্থা হারিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী সংস্কারের কড়া দাওয়াই তো দূরের কথা, আরও বেশি করে জনমুখী প্রকল্পের জন্য টাকা বরাদ্দ করছেন। দু’দিন আগেই কার্যত সনিয়া গাঁধীর সুরে বলেছেন, জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়ানোই সংস্কারের একমাত্র লক্ষ্য নয়। গরিবতম মানুষের অবস্থার পরিবর্তনই সংস্কার। পাশাপাশি, ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ আর সর্বোচ্চ সুশাসনের আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এলেও মোদীর সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও বেশি করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পথে এগোচ্ছে বলে অভিযোগ।
বিহারের ক্ষেত্রেও উন্নয়ন নয়, মেরুকরণই ছিল বিজেপির প্রচারের মূল কেন্দ্রবিন্দু। মোদী নিজে হয়তো উন্নয়নের কথাই বলেছেন, কিন্তু পরের ধাপের বিজেপি নেতাদের লক্ষ্য ছিল উগ্র হিন্দুত্বের প্রচার। আর তা নিয়ে মোদীর নীরবতাকে তাঁর সমর্থন হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছে বিজেপি বিরোধীরা। তাঁদের মতে, দল মেরুকরণের চেষ্টা চালাবে, অন্য দিকে মোদী গা-বাঁচিয়ে উন্নয়নের কথা
বলবেন, এটাই ছিল বিজেপির
দ্বিমুখী কৌশল। কিন্তু বিহারের মহাধাক্কার পরে বিজেপি নেতাদেরই অনেকে আশঙ্কা করছেন, এই কৌশলের জেরে মোদীর আম-ছালা দুই-ই যেতে পারে।
কেন? বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, বিহারের ফলাফলের প্রভাব শুধু সেই রাজ্যের সীমায় আটকে নেই। এই পরাজয়ে ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি তার বিশ্বাসযোগ্যতা খোয়াল এবং মেরুকরণের রাজনীতিও তার কার্যকারিতা হারাল! টামাক (তামাক) এবং ডুডু, দু’টি যে একসঙ্গে সেবন করা যায় না, সেটা বোঝার সময় মোদীর বোধহয় এ বার এসেছে।
জাতপাতের সাবেকি সমীকরণ ভেঙে দিয়ে উন্নয়নের রথ চালাবেন, এমন আশার বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন মোদী। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তার জন্য যে দৃঢ় সঙ্কল্প দরকার, সেটা তাঁর নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত। মেরুকরণের রাজনীতি বা সঙ্ঘ-লাইন বর্জন করতে তিনি পারেননি। কারণ এর আগে উত্তরপ্রদেশে মুজফ্ফরনগরের সংঘর্ষ ভোটে কাজে এসেছিল। আবার মহারাষ্ট্রেও একই ভাবে সাম্প্রদায়িকতার তাস কাজ দিয়েছিল। কিন্তু বিহারে এ বার এই অঙ্কে লাভ হয়নি। নীতীশকে অভিনন্দন জানিয়ে মোদীকে বুঝতে হচ্ছে, গোমাংস বিতর্ক-দাদরি কাণ্ডে তাঁর ক্ষতিবৃদ্ধি ছাড়া কিছুই হয়নি।
বিজেপি নেতাদের অনেকে অবশ্য বলছেন, লালু-নীতীশের জোট জাতপাতের সমীকরণের উপরেই দাঁড়িয়ে। লালু যাদব ভোটের উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখবেন এবং নীতীশ কুর্মি ভোটের উপরে— এটা মোটের উপর জানাই ছিল। মুসলিম ভোটও তাঁদের দিকেই যেত। এর বাইরে যে সব সম্প্রদায় আছে তাদের ভোট টানতে শুধু উন্নয়নের স্লোগানে কাজ হবে না বলেই মনে করা হয়েছিল। সেই কারণেই মেরুকরণের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নের তাস ও মেরুকরণের রাজনীতি, দু’টিই একসঙ্গে করতে গিয়ে অভিমুখ হারালেন মোদী।
জাতপাতের সমীকরণ যে শুধু বিহারেই রয়েছে এমন নয়। এর পর উত্তরপ্রদেশের ভোট। সেখানেও জাতপাতের ভূমিকা বিরাট। সেখানে পাল্টা কোন রণকৌশল কার্যকর হবে, বিহার থেকে শিক্ষা নিয়ে তা ঠিক করতে হবে মোদীকে। অমিত শাহের সঙ্গে এ দিনই বৈঠক করেছেন তিনি। আগামিকাল অথবা মঙ্গলবার সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে বিহার
নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। বিজেপি নেতারা বলছেন, মোদীর পিছনে ২৮২ জন সাংসদের সমর্থন আছে। সুতরাং সঙ্ঘ পরিবার বা ভোট রাজনীতির কথা পরে ভাবব, আমার সরকারের প্রধান বিষয় হোক উন্নয়ন— মোদীর এমন কথা বলার সময় এসে গিয়েছে। সেটা করতে না পারলে ভবিষ্যতে দুঃখ আছে।
কার্যক্ষেত্রে সেটা কতটা হবে, তা নিয়ে অবশ্য বিশ্লেষকদের মধ্যে দু’রকম মতই আছে। এক দল বলছেন, বিহারে হেরে গিয়ে এক প্রকার ভালই হল। মোদী এ বার সঙ্ঘ পরিবারের আগল ভেঙে বেরিয়ে আসার সুযোগ পাবেন। নিজের কাঁধে নীতি-নির্ধারণের পূর্ণ দায়িত্ব নিতে পারবেন। নিজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারবেন। আবার অন্য এক দলের মতে, আদৌ সীমাবদ্ধতার কারণে
নয়, এই হার মোদীর আমিত্বের কারণে। রাহুল গাঁধী যেমন দাবি করেছেন, এটা মোদী এবং তাঁর দলের অহঙ্কারের হার। তাঁর পরামর্শ, মোদী এ বার অন্তত গাড়িতে স্টার্ট দিন, কাজ করে দেখান!
মতান্তর নেই একটা বিষয়ে। সেটা হল, উন্নয়নের যে রথটা বিহারে কাদায় আটকে গেল, তাকে ঠেলে তোলার দায়িত্বটা কিন্তু মোদীরই। শিল্পমহলও চাইছে, মোদী তাঁর প্রতিশ্রুত উন্নয়নের কাজেই পূর্ণ মনোনিবেশ করুন! তাতেই কার্যসিদ্ধি হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy