গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সেমিফাইনালে গেরুয়া ঝড়। রবিবার চার রাজ্যের ভোটের ফলপ্রকাশের পর দেখা গেল হাতে থাকা দু’টি রাজ্য হারাল কংগ্রেস। এক রাজস্থান এবং দুই, ছত্তীসগঢ়। বিপুল ভাবে হিন্দিবলয়ের দু’টি রাজ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে গেরুয়া শিবির। মধ্যপ্রদেশে যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার অঙ্ক কষে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটে গিয়েছিল কংগ্রেস, সেখানেও তাদের বড়সড় ধাক্কা খেতে হয়েছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে ২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশে ১১৬টি আসন পেয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে পদ্মফুল। কংগ্রেসের ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ কেবল তেলঙ্গানা। দক্ষিণ ভারতে ২০১৪ সালে নতুন রাজ্য তৈরি হওয়ার পর এই প্রথম সেখানে সরকার গড়বে কংগ্রেস। যে যে হেতু আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই লোকসভা ভোট হবে, তাই এই পাঁচ রাজ্যের ভোটকে (মিজ়োরামের ভোট গণনা মঙ্গলবার) সেমিফাইনাল হিসেবে দেখছিলেন রাজনৈতিক মহলের অনেকে। সে দিক থেকে লোকসভার লড়াইয়ে হিন্দিবলয়ের তিন রাজ্যে বিজেপির জয় গেরুয়া শিবিরকে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে বলেই মত অনেকের।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে হিন্দিবলয়ের এই তিন রাজ্যেই ভোটে জিতেছিল কংগ্রেস। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সরকার পড়ে যায়। হাত শিবিরের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। অতঃপর দল ছেড়ে বেশ কিছু বিধায়ক নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে।। এখন তিনি কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী। সেই থেকে সরকার চালিয়েছে বিজেপি। তার আগেও টানা ক্ষমতায় ছিল গেরুয়া শিবির। ফলে রবিবার ফল স্পষ্ট করে দিয়েছে, মধ্যপ্রদেশে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কোনও হাওয়াই কাজ করেনি। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বিধানসভা ভোটে এই তিন রাজ্যে কংগ্রেস জিতলেও পরের বছর লোকসভা ভোটে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। ফলে ২০১৯-এর সেমিফাইনাল আর ফাইনালের ফল এক ছিল না।
যদিও ভোটে জয়ের পর দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘‘ভারতের মানুষ স্থায়ী সরকার চান। ভারতের কোনও নাগরিক আমাদের উন্নয়নযাত্রায় পিছিয়ে পড়বেন না। সবার জন্য সরকার। সবার জন্য উন্নয়ন। কেউ কেউ বলছেন, আজকের এই জয়ের হ্যাটট্রিক হল ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের জয়ের গ্যারান্টি। মোদীর গ্যারান্টি দেওয়া গাড়ি সবার দ্বারে দ্বারে আসছে।’’
মধ্যপ্রদেশ
মধ্যপ্রদেশের ভোটে এ বার মহিলাদের সমর্থন ঢেলে বিজেপির দিকে গিয়েছে বলে মত রাজনৈতিক মহলের অনেকের। যা গেরুয়া শিবিরকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের ‘লাডলি বহেন যোজনা’ সেখানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই প্রকল্প অনেকটা বাংলায় লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো। ভোটের মুখে মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শিবরাজ। কয়েকটি বুথ ফেরত সমীক্ষায় স্পষ্ট তার প্রভাব ধরা পড়েছিল। পুরুষদের ভোটে তুল্যমূল্য লড়লেও মহিলাদের ভোটের ক্ষেত্রে বিজেপি কংগ্রেসের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশে এগিয়ে থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ফল বলছে তা-ই হয়েছে। কংগ্রেস ভোটের আগে টাকা বিতরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তা কার্যত বুমেরাং হয়েছে।
যদিও শিবরাজ টানা পঞ্চম বার ভোপালের কুর্সিতে ফিরতে চলেছেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ ‘তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে’ চার বারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজকে এ বার ভোটের আগে ‘মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসাবে ঘোষণা করেনি বিজেপি। ভোটের প্রচারেও ‘মামা’র (অনুগামীদের কাছে এই নামেই পরিচিত শিবরাজ) তুলনায় ‘মোদীত্বে’ বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণের প্রাথমিক প্রবণতা বলছে, বিজেপির জয়ে তাঁর অবদান কম নয়।
রাজস্থান
মরুরাজ্যের রেওয়াজ পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল। তা থেকে এ বার বিচ্যুত হল না রাজস্থান। ১১৫টি আসন জিতে কংগ্রেস সরকারকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। কিন্তু কুর্সির দখল পাকা হতেই আলোচনা শুরু হয়েছে কুর্সির ‘দাবিদার’ নিয়ে। কে হবেন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী? দাবিদারের দীর্ঘ তালিকার সামনে ধন্দে পড়েছেন রাজনৈতিক নজরদারেরাও। বসুন্ধরা রাজে, দিয়া কুমারী, যোগী বালকনাথের পাশাপাশি রাজপুত নেতা গজেন্দ্র সিংহ শেখাবত, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘাওয়াল, রাজস্থান বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি সতীশ পুনিয়া, বিজেপি সাংসদ সিপি যোশী এবং অলিম্পিক্স পদকজয়ী বিজেপির লোকসভা সাংসদ রাজ্যবর্ধন রাঠৌড়দের নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত পাঁচ বছর অশোক গহলৌত সরকার চালালেও রাজস্থান কংগ্রেসের মধ্যে সেই ঠাসবুনোট ভাব দেখা যায়নি। মাঝে মাঝেই গহলৌতের সঙ্গে তরুণ নেতা সচিন পাইলটের কোন্দল প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। যার শুরুটা হয়েছিল গত বার বিধানসভা ভোটের ঠিক পরেই। এ বার ভোটের আগে দু’জনের হাত ধরার ফ্রেম তৈরি করে ঐক্য দেখানোর চেষ্টা হলেও কংগ্রেসের হাত ছাড়ল রাজস্থান।
ছত্তীসগঢ়
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি ঘটিয়ে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে জিতে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টি জিতেছিল তারা। বিজেপি মাত্র ১৫টি। তবে গত পাঁচ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় রাজ্যনেতারা নন, রায়পুরের কুর্সিতে ফিরতে এ বার ‘মোদীত্বেই’ ভর করেছিল বিজেপি। ভোটের ফল বলছে, সেই রণকৌশলে সফল হয়েছে গেরুয়া শিবির। এ বার কংগ্রেস নেমে এসেছে ৩৫-এ। বিজেপি জিতেছে ৫৪টি আসন।
ভোটপণ্ডিতদের একাংশ মনে করেছিলেন, এ বার প্রচারপর্বের শেষবেলায় মূলত দু’টি বিষয় কংগ্রেসের বিপক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশের বিরুদ্ধে ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ’ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ। দ্বিতীয়, প্রভাবশালী দলিত জনগোষ্ঠী সতনামী সমাজের অবিসংবাদী নেতা গুরু বালদাসের বিজেপিকে সমর্থন। অন্যদিকে, কংগ্রেসের দাবি ছিল, বঘেলের বিরুদ্ধে ভোটের ঠিক আগেই কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি-র ‘অতি সক্রিয়তা’ ব্যুমেরাং হবে বিজেপির কাছে।
ভোটের ফল বলছে, ইডি-র ‘অতিসক্রিয়তা’ নিয়ে কংগ্রেসের প্রচারে সাড়া মেলেনি। বরং এক মাসে বিজেপির ‘মহাদেব’ প্রচার ছাপ ফেলেছে ছত্তীসগঢ়বাসীর মনে। প্রসঙ্গত, গত ৩ নভেম্বর ইডি-র তরফে দাবি করা হয়েছিল, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভিলাই থেকে অসীম দাস নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে তারা। কেন্দ্রীয় সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের নির্বাচনের খরচ জোগাতে ওই ব্যক্তিকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে পাঠিয়েছিলেন ‘মহাদেব’ অ্যাপের মালিকেরা। ইডি-র দাবি, ‘বঘেল’ নামে এক রাজনীতিককে দেওয়ার জন্য অসীম ৫.৩৯ কোটি টাকা নিয়ে এসেছিলেন দুবাইয়ে আশ্রয় নেওয়া ‘মহাদেব অ্যাপ’-এর মালিকের কাছ থেকে।
তেলঙ্গানা
হিন্দি ভারতে কংগ্রেস ধাক্কা খেলেও তারা প্রথম বার ক্ষমতার স্বাদ পেতে চলেছে দক্ষিণের তেলঙ্গনায়। ১১৯ আসনের তেলঙ্গানা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ৬০। কংগ্রেস ৬৫টি আসনে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে। কেসিআরের বিআরএস (ভারত রাষ্ট্র সমিতি। আগে নাম ছিল টিআরএস বা তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি) পেয়েছে ৩৯টি। তেলঙ্গানায় গত বিধানসভা নির্বাচনের পর তেড়েফুঁড়ে উঠলেও বিজেপি জিতেছে ৮টি আসন। আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম) যে ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল তার মধ্যে ৭টিতে জিতেছে। কর্নাটকের পর দক্ষিণের আরও একটি রাজ্যে ক্ষমতা দখল করল কংগ্রেস। যা বিপর্যের মধ্যেও হাত শিবিরের কাছে ‘আশার প্রদীপ’ হতে পারে বলে মত অনেকের।
মোদী যা বললেন
তিন রাজ্যে জয়ের পরেই সন্ধ্যায় দিল্লির বিজেপি সদর দফতরে গিয়ে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কংগ্রেসের উদ্দেশে আক্রমণ শানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দেশের সেবা করার জন্য রাষ্ট্রসেবা করতে হয়। অহংকার, নিরাশা, নেতিবাচক হেডলাইন দেয় সংবাদমাধ্যমকে। জনতার মনে স্থান দেয় না। নতুন কোনও প্রকল্প হলে, গরিবের জন্য বাড়ি তৈরি করলে কংগ্রেস এবং তার সঙ্গীরা ব্যঙ্গ করে। আপনারা শুধরে যান। জনতা না হলে আপনাদের বেছে বেছে সাফ করে দেবে।’’ বিজেপি কর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আজ উন্নয়নের জন্য বসে থাকা মানুষজন জানেন, তাঁদের আশা এবং আকাঙ্খা কেবল বিজেপিই পূরণ করতে পারে। আর বিজেপির কর্মকর্তাদের আজ ভূরি ভূরি প্রশংসা করব। আপনাদের কষ্টের ফল আজ আমরা পাচ্ছি। আমাদের সভাপতি নড্ডাজির রণনীতির জন্য এই জয়ের ভাগীদার তিনি। তাঁরও প্রশংসা প্রাপ্য।’’ তেলঙ্গনায় বিজেপি হারলেও সেখানেও যে দলের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে তা-ও উল্লেখ করেন তিনি।
রাহুল যা বললেন
ভোটের এই ফলে পরাজয় স্বীকার করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তাঁর কথায়, ‘‘জনতার রায়কে বিনয়ের সঙ্গে আমরা স্বীকার করছি। তবে চিন্তাধারার লড়াই জারি থাকবে।’’ রবিবার ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, এবং মধ্যপ্রদেশে পরাজিত হয়েছে কংগ্রেস। ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থানে তারা গদিচ্যুত হয়েছে। ওই দুই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছে বিজেপি। লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের জন্য যা বড় ধাক্কার। অন্তত ভূপেশ বঘেলের রাজ্যে এত খারাপ ফল হবে আশা করেননি অনেক কংগ্রেস নেতাও। রবিবার বিকেলে ‘এক্স হ্যান্ডলে’ রাহুল লেখেন, ‘‘মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং রাজস্থানে জনতার রায়কে বিনয়ের সঙ্গে মেনে নিচ্ছি। তেলঙ্গানার মানুষকে আমার অনেক ধন্যবাদ। আমরা অবশ্যই উজ্জ্বল তেলঙ্গানা গড়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করব। সমস্ত কর্মীর পরিশ্রম এবং সমর্থনের জন্য মন থেকে শুভেচ্ছা জানাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy