এখনও আতঙ্কে হাথরসের নির্যাতিতার পরিবার। ফাইল ছবি।
মেয়েটির রোজের ব্যবহারের সেই সেলাই মেশিনে আজ পুরু ধুলোর আস্তরণ। তাকে রাখা জামাকাপড়েও অব্যবহারের ছোঁয়া। ছোট্ট মাটির কলসে এখনও ঢেকে রাখা ছাই, দেহাবশেষ। সুবিচার না মেলা পর্যন্ত মেয়ের শেষকৃত্য না করার পণ নিয়েছে উত্তরপ্রদেশের হাথরসের দলিত পরিবার।
ঠিক এক বছর আগে, ১৪ সেপ্টেম্বর উচ্চবর্ণের চার জনের লালসার শিকার হতে হয়েছিল হাথরসের ১৯ বছরের দলিত তরুণীকে। ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটালেও, পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি যোগীরাজ্যের হাথরসে।
উচ্চবর্ণের চার ব্যক্তি দলিত তরুণীটিকে গণধর্ষণের পর একটি মাঠে ফেলে পালায়। বাড়ির লোকেরা যখন তরুণীকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করেন, তখন তাঁর কাঁধ ও গোপনাঙ্গে ভয়ানক আঘাত। ১১ দিন লড়ে শেষ পর্যন্ত দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে মৃত্যু হয় হাথরসের দলিত তরুণীর।
তরুণীর মৃত্যুর পর শুরু আর এক নাটক। তরুণীর দেহ একটি অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে গ্রামে আনা হয়। কিন্তু পরিবারের হাতে তুলে না দিয়ে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ও সরকারি কর্তাদের উপস্থিতিতে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতা তরুণীর মৃতদেহ। ঘটনা নিয়ে তোলপাড় পড়ে যায়। এর পর কেটেছে এক বছর। কেমন আছে সেই দলিত পরিবারটি?
ঘটনার পর থেকে হাথরসের দলিত পরিবারটিকে ঘিরে রয়েছে একাধিক সিসিটিভি। ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে তাঁদের প্রতিটি কার্যকলাপ জরিপ করা হয় প্রশাসনিক সদর দফতর থেকে। পাশাপাশি মোতায়েন ৩৫ জন সিআরপিএফ জওয়ানের প্রতিনিয়ত নজরদারি। আর এই বজ্র আঁটুনির মধ্যে পড়ে যায় যায় অবস্থা নির্যাতিতা তরুণীর পরিবারের। মৃত তরুণীর এক দাদা বলছেন, ‘‘দমবন্ধ হয়ে আসছে। কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা হয় যেন আমরা দাগি অপরাধী! আমরা জানি, সিআরপিএফ সরে গেলেই গ্রামবাসীরা আমাদের উপর হামলা করবে। বাড়িতে তিনজন কমবয়সী মেয়ে আছে। ওদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।’’
ঘটনার পরই চাকরি হারিয়েছেন নির্যাতিতা তরুণীর দাদা। তরুণীর বাবারও কোনও কাজ নেই, বাড়িতে বসে থাকেন। মেয়ের সুবিচারের দাবিতে মামলা চালাতে গিয়ে বেচতে হয়েছে গোয়ালের সমস্ত গরু, মোষ। সম্বল বলতে আর কিছুই নেই। প্রতিশ্রুতি মতো ২৫ লক্ষ টাকা পেলেও, যোগী আদিত্যনাথ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি এখনও জোটেনি। উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত হাথরসের এই গ্রামে কী ভাবে বেঁচে থাকছে নির্যাতিত দলিত পরিবার? ৭০-৮০ বছর ধরে যে গ্রামে বসবাস, তা ছাড়া কি মুখের কথা?
সর্বদা মনে ভয়, সরকারি নজরটুকু উঠলেই আবার হামলার মুখে পড়ার। নির্যাতিতা তরুণীর বাবা বলছেন, ‘‘আমরা যখন কোর্টে যাই, গোটা গ্রাম আমাদের পিছু নেয়। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কেউ নেই, আমরা সম্পূর্ণ একা। কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। উল্টে আইজীবীকে হুমকি দেওয়া হয়, মামলা ছেড়ে দেওয়ার জন্য।’’
তরুণীর দাদার প্রশ্ন, ‘‘আমরা চাই গ্রামবাসীরা আমাদের মেনে নিক। আমরা কী ভুল করেছি বলতে পারেন? বাজার যেতে পারি না, মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না আমাদের। এখন বাড়িতে বসে থাকি আর প্রার্থনা করে যাই, আদালত দ্রুত যেন সুবিচার দেয়।’’
সুবিচার কি পাবে হাথরসের দলিত মেয়েটির পরিবার? শাস্তি হবে উচ্চবর্ণের অভিযুক্ত ধর্ষকদের? উত্তর লুকিয়ে সময়ের গর্ভে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy