প্রতীকী ছবি।
হিন্দু এয়োস্ত্রী মানেই যে সিঁথিতে সীমান্তরাগ, হাতে শাঁখা, পলা, লোহা— সেই ধারণাতেই আইনি সিলমোহর দিলেন গৌহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অজয় লাম্বা ও বিচারপতি সৌমিত্র শইকিয়া।
তিনসুকিয়া জেলার ডিগবয়ের বাসিন্দা ভাস্কর দাস স্ত্রী রেণু দাসের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে মামলা করেছিলেন। অনেক দিন তাঁদের বনিবনা নেই। বিয়ের এক মাসের মধ্যেই শ্বশুরবাড়িতে থাকতে নারাজ হন রেণুদেবী। ঠিকা শ্রমিক স্বামী পরে স্ত্রীকে নিয়ে কর্মস্থলে থাকা শুরু করলেও ঝামেলা মেটেনি। স্বামী সন্তানধারণে অক্ষম— এই অভিযোগ তোলেন রেণুদেবী। ভাস্করবাবুর দাবি, ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা যায় তাঁর সমস্যা নেই, সমস্যা রয়েছে স্ত্রীর। ২০১৩ থেকে পৃথক থাকতে শুরু করেন স্ত্রী। তিন বার গার্হস্থ্য হিংসার মামলাও করেছিলেন স্বামী-শ্বশুরবাড়ির বিপক্ষে। প্রথমে নিজে বিচ্ছেদ চাইলেও ভাস্করবাবু যখন ডিভোর্সের মামলা করেন তখন বেঁকে বসেন রেণুদেবী। পারিবারিক আদালতও স্ত্রীর পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু হাইকোর্ট স্ত্রীর ভাষ্যের একটি মন্তব্যকে ভিত্তি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন মঞ্জুর করেছে।
বিচারপতি লাম্বা ও বিচারপতি শইকিয়ার বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, তিনি ভাস্কর দাসকে আর স্বামী হিসেবে মানেন না। তাই শাঁখা-সিঁদুর পরা ছেড়ে দিয়েছেন। বেঞ্চের মতে, হিন্দু বিবাহ আইন অনুযায়ী বিয়ে হওয়া মহিলা হিন্দু শাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনেই বিয়ে করেন। এই মামলায় স্ত্রী সেই কথা অস্বীকার করেননি। বরং তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ভাস্করবাবুকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেন না বলেই তিনি শাঁখা-সিঁদুর পরছেন না। হাইকোর্টের মতে, রেণুদেবীর শাঁখা-সিঁদুর না পরার অর্থ নিজেকে অবিবাহিত হিসেবে দেখানো। এ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় স্ত্রী আর স্বামীর সঙ্গে থাকতে চাইছেন না ও বিয়ে মানছেন না। বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘শাঁখা-সিঁদুর না-পরা মানে নিজেকে অবিবাহিতা মনে করা বা সেই বিয়ে মেনে না-নেওয়া।’’
বৃদ্ধা শাশুড়ির সঙ্গে দুর্ব্যবহার, মিথ্যে মামলা করা, ছেলেকে জোর করে নির্ভরশীল মায়ের থেকে পৃথক রাখা, বৃদ্ধ অভিভাবকের যত্ন না-করারও অভিযোগ রয়েছে রেণুদেবীর দিকে। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন খারিজ করে পারিবারিক আদালত সেই সব অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মনে করছে হাইকোর্টের বেঞ্চ।
রেণুদেবী বলেছিলেন হয় স্বামী তাঁর সঙ্গে ডিব্রুগড়ে থাকুক, নয়তো চাহিদামতো টাকা পেলে তিনি ডিভোর্স দেবেন। কিন্তু শাঁখা-সিঁদুর না-পরার বক্তব্যের উপরে জোর দিয়ে ও ২০১৩ থেকে একসঙ্গে না-থাকা দম্পতির মধ্যে দাম্পত্যের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না বলে মন্তব্য করে বিচারপতি লাম্বা ও বিচারপতি শইকিয়ার বেঞ্চ গত ১৯ জুন বিবাহবিচ্ছেদ মঞ্জুর করেছে। বেঞ্চের যুক্তি, এই পরিস্থিতিতে জোর করে বিয়ে টিকিয়ে রেখে লাভ নেই।
আরও পড়ুন: গালওয়ানে ভারতীয় ভূখণ্ডের ৪২৩ মিটার অন্দরে চিনা শিবির
বিচারপতিদের মন্তব্যের সরাসরি সমালোচনা না-করলেও অনেকেই এই উক্তিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। পার্সোনাল ল’ নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলাঞ্জনা গুপ্ত। তাঁর মতে, ‘‘যে কোনও পার্সোনাল ল’য়েরই ভিত্তি ধর্ম। সেই সব আইনে মনে করা হয় না যে, মহিলাদের আলাদা কোনও আইনি সত্তা রয়েছে।’’ গুয়াহাটির কটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘উজানি অসমে শাঁখা পরার চল নেই। বিবাহিত হওয়ার প্রমাণ হিসেবে নারীকে শাঁখা বা সিঁদুর পরে থাকতেই হবে, এমন মনোভাব সমর্থনযোগ্য নয়।’’ কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী অয়নাভ রাহা আবার জানাচ্ছেন, হিন্দু বিবাহ আইনে বিয়ের সময়ে সপ্তপদী ও তৎসংক্রান্ত আচার মানার কথা রয়েছে, তবে শাঁখা-সিঁদুরের কোনও উল্লেখ নেই।
আরও পড়ুন: ‘ডিজিটাল স্ট্রাইক’ চিনের বিরুদ্ধে, টিকটক-সহ ৫৯ অ্যাপ নিষিদ্ধ দেশে
অসমের সাহিত্যিক অনুরাধা শর্মা পুজারী বলেন, ‘‘মহামান্য আদালত লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। মানবাধিকার রক্ষা করে। কিন্তু সেই আদালতই যদি বিয়ের চিহ্ন হিসেবে শাঁখা-সিঁদুর পরা বাধ্যতামূলক বলে মনে করে, তা দুর্ভাগ্যজনক।’’ আর কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর মতে, ‘‘এ হল বহুযুগ ধরে সযত্নে পুষে রাখা চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিফলন। আইন বা আদালতের রায় নিয়ে মন্তব্য করব না। কিন্তু এই নির্দিষ্ট মামলাটির ক্ষেত্রে মহিলাও সেই শাঁখা-সিঁদুরকেই হাতিয়ার করে স্বামীর সঙ্গে লড়তে নেমেছেন। তারই বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে রায়ে। শাঁখা-সিঁদুর পরা অবশ্যই কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয়। কোনও শাঁখা-সিঁদুর পরা মেয়ে মানেই সে কোনও পুরুষের সম্পত্তি। তার দিকে আর হাত বাড়াব না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy