যুদ্ধসাজ। পাঠানকোটের বায়ুসেনা ঘাঁটির বাইরে দুই জওয়ানের নজরদারি।— এএফপি
প্রথম গুলির শব্দ শোনা যাওয়ার পর থেকে কেটে গিয়েছে প্রায় সত্তর ঘণ্টা! অর্থাৎ দু’ঘণ্টা কম তিন দিন। কিন্তু এখনও স্পষ্ট হল না, পাঠানকোট বায়ু সেনা ঘাঁটি শেষ পর্যন্ত জঙ্গি মুক্ত হল কি না! এখনও সেই প্রশ্নটাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে, আর ক’জন আছে ভিতরে?
সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট ছয় জঙ্গি মারা গিয়েছে বলে সরকারি ভাবে বলা হলেও সেনাবাহিনী রাতেও বলেছে, তল্লাশি অভিযান চালু রয়েছে। অর্থাৎ, বিমানঘাঁটির ভিতরে এখনও জঙ্গি লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না খোদ নিরাপত্তাবাহিনীই!
গত দু’দিনে ঠিক ক’জন জঙ্গি মারা গিয়েছে, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা সব মহলে! আজ সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি জানান, চার জঙ্গির দেহ উদ্ধার হয়েছে। বাকি দু’জনের দেহ ধ্বংসস্তূপে আটকে রয়েছে। সেগুলি বাইরে আনতে সময় লাগবে। গোয়েন্দাদের অনুমান ছিল, দু’দলে ভাগ হয়ে মোট ছ’জন জঙ্গি বিমানঘাঁটিতে ঢুকেছিল। সেই যুক্তি মেনে নিলে পাঠানকোট বিমানঘাঁটি এখন জঙ্গি মুক্ত। কিন্তু শনিবার রাতে আগ বাড়িয়ে ‘অপারেশন শেষ’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ মুখ পোড়ানোর পরে আর কেউ কোনও ঝুঁকি নিচ্ছেন না। সেনা সূত্রে বলা হয়েছে, ওই বিমানঘাঁটির পরিধি প্রায় ২৪ কিলোমিটার। গোটা এলাকা তল্লাশি চালিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদ ঘোষণা না করা পর্যন্ত সরকারি ভাবে ‘অপারেশন’ জারি থাকবে। এর মধ্যেই আজ সন্ধ্যায় ওই হামলার দায় নিয়েছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গি সংগঠন ইউনাইটেড জেহাদ কাউন্সিল (ইউজেসি)। সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে তারা জানিয়েছে, স্বাধীন কাশ্মীরের লক্ষ্যেই তাদের ‘হাইওয়ে স্কোয়াড’ ওই হামলা চালিয়েছে।
রবিবার রাতভর মোটামুটি চুপ থাকার পর আজ সকাল ন’টা থেকে গুলির আওয়াজ শোনা যায় ঘাঁটি চত্বরে। সেনা সূত্রের খবর, ঘাঁটির মধ্যে আবাসিক এলাকার একটি বাড়ি ও ক্যান্টিন থেকে সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুটে আসতে থাকে। দ্রুত জঙ্গিদের অবস্থান বুঝে নিয়ে জঙ্গি নিকেশে একযোগে হামলা চালায় সেনা, এনএসজি ও গরুড় বাহিনী। প্রথমে আবাসিক বাড়িটিতে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিকে নিকেশ করতে এগোয় তারা। বাড়ির একটি অংশ বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
দুপুরে সেনা সূত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, পঞ্চম জঙ্গি মারা গিয়েছে। তখন শুরু হয় ক্যান্টিনে থাকা ষষ্ঠ জঙ্গি নিকেশ অভিযান। তার কাছে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক আছে বুঝেই সতর্ক হয়ে এগোতে থাকে সেনাবাহিনী। কিছুক্ষণ গুলি চালানোর পরে তাই ক্যান্টিনের ওই অংশটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা দুই জঙ্গির দেহ রাত পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি। সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ এনএসজি-র মেজর জেনারেল দুষ্মন্ত সিংহ বলেন, ‘‘অপারেশন এখনও চালু রয়েছে। তল্লাশি চলছে।’’
ছয় জঙ্গি মারা যাওয়ার পরেও কিন্তু পাঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে গুলির শব্দ মিলিয়ে যায়নি! মোট ২১টি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছে! সেনা সূত্রে বলা হচ্ছে, জঙ্গিদের কাছে থাকা বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক নষ্ট করতেই ওই বিস্ফোরণগুলি ঘটানো হয়েছে। আরও জঙ্গি লুকিয়ে রয়েছে কি না, তা দেখতে ঘাঁটির কৌশলগত স্থানে গুলি চালিয়ে দেখা হচ্ছে পাল্টা গুলি ছুটে আসছে কি না। তাই রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ মিলেছে।
মাত্র ছ’জন জঙ্গি যে ভাবে তিন দিন ধরে লড়াই চালিয়েছে, তাতে অবাক সব মহলই। সেনা সূত্র বলছে, ওই জঙ্গিরা কম্যান্ডো পর্যায়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যা কেবল কোনও সেনাবাহিনীর পক্ষেই দেওয়া সম্ভব এবং সেই সূত্রেই ফের সামনে উঠে আসছে পাক সেনার যোগের বিষয়টি। তা ছাড়া যে ভাবে তিন দিন ধরে তারা লড়াই চালিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট, দীর্ঘ লড়াই চালানোর লক্ষ্যেই জঙ্গিরা প্রচুর পরিমাণে হাতিয়ার, বিস্ফোরক, শুকনো খাবার ও জল নিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘এরা মুম্বই হামলাকারীদের চেয়েও এক ধাপ উন্নত প্রশিক্ষণ পেয়েছিল! এই জঙ্গিরা টেকনিক্যাল এরিয়ায় ঢুকে পড়লে বড় ক্ষতি হতে পারত।’’
জঙ্গি হামলা সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল। তবুও কী ভাবে জঙ্গিরা সেনা ঘাঁটিতে ঢুকল এই প্রশ্ন তো উঠছেই। তেমনই মাত্র ছ’জন জঙ্গিকে নিকেশ করতে কেন এত সময় লাগল, সে প্রশ্নও উঠছে। গত দু’দিনের মতো আজও সেনা সূত্রে বলা হয়েছে, খবর ছিল বলেই বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গিয়েছে। না হলে জঙ্গিরা টেকনিক্যাল এরিয়ার ক্ষতি করে দিত। তাদের ক্যান্টিন ও বায়ু সেনার দফতর ভবনের মধ্যেই আটকে দেওয়া গিয়েছে। তা ছাড়া ওই ঘাঁটি চত্বরে প্রায় ১৫০০ পরিবার থাকে। তারা সকলেই সুরক্ষিত আছেন বলে জানিয়েছেন এনএসজি-র মেজর জেনারেল। আর সময় লাগা? জেটলির যুক্তি, ‘‘ওই ঘাঁটির পরিধি প্রায় ২৪ কিলোমিটার। বড় বড় গাছ ও জঙ্গল রয়েছে। তাই প্রতিটি ইঞ্চি তল্লাশি করেই সেনা এগোচ্ছে। তা ছাড়া আমাদের অন্যতম লক্ষ্য, যাতে আরও ক্ষতি না হয়।’’
কারা হামলার পিছনে, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি জেটলি। গোড়ায় গোয়েন্দারা বলেন, হামলার পিছনে মাসুদ আজহারের জইশ-ই-মহম্মদ। কিন্তু সোমবার ইউনাইটেড জেহাদ কাউন্সিল হঠাৎই দায় নেয়। ভারতবিরোধী ১৩টি জঙ্গি গোষ্ঠীর ছাতা সংগঠন হিসেবে কাজ করে ইউজেসি। সংগঠনের মুখপাত্র সৈয়দ সাদাকত হুসেনের দাবি, ‘‘পাঠানকোটের আক্রমণ বার্তা দিয়েছে, ভারতের যে কোনও সেনা ছাউনিতেই জঙ্গিরা হামলা চালাতে সক্ষম। পাকিস্তানকে দোষ দেওয়ার পরিবর্তে ভারতের উচিত কাশ্মীরের মানুষকে তাঁদের ভাগ্য নির্ধারণ
করতে দেওয়া।’’
গোয়েন্দাদের মতে, তদন্তকে ভুল পথে চালিত করতে পরিকল্পিত ভাবেই হামলার দায় নিয়ে সামনে এসেছে ইউজেসি। কারণ পাঠানকোট কাণ্ডেও সরাসরি পাক যোগের প্রমাণ হাতে এসেছে। যা ইসলামাবাদের পক্ষে অস্বস্তির। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, সম্ভবত পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর নির্দেশে ইউজেসি এই দায় নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই হামলার পিছনে সরকারি ভাবে যেমন পাকিস্তানের জড়িত থাকার কথা বলা যাবে না, তেমনই কাশ্মীর প্রশ্নটি তুলে আন্তর্জাতিক মহলে মুখ খোলার সুযোগ পাবে ইসলামাবাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy