Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Bilkis Bano

‘ক্ষমা পরম ধর্ম’, ধর্ষণকারীকেও!

কুড়ি বছর ধরে গুজরাত দাঙ্গার সময়ে ধর্ষিত বিলকিসের জন্য যে ভাবে উদ্বেগ দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ, এই ধর্ষকদের মুক্তি কামনা যে সে ভাবে করেনি, সেটা আমতা আমতা করেও ওই প্রতাপশালী স্থানীয় নেতাদের সামনে বলতেই হল।

বিলকিস গণধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তেরা ছাড়া পাওয়ার পরে। ফাইল চিত্র।

বিলকিস গণধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তেরা ছাড়া পাওয়ার পরে। ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
গোধরা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৫১
Share: Save:

প্রবীণ হলেও দীর্ঘদেহী, সুঠাম পালোয়ানসুলভ চেহারা কেতনভাই পারেখের। গোধরায় অমিত শাহের ছায়াসঙ্গী হিসেবে স্থানীয় বিজেপিতে পূজ্য। গেরুয়ার সৌরভে আমোদিত। জলদগম্ভীর কণ্ঠ। নিছক ধমক নয়, যেন বাজই পড়ছে বিজেপি অফিসে।

তা সেই কেতনভাই বলছিলেন, “আজ আপনারা এসে এত কথা বলছেন। বিলকিসের হয়ে দরদ দেখাচ্ছেন। আর কুড়িটা বছর যে ওই ছেলেগুলো আটকে পড়ে ছিল, তা নিয়ে তো কই কাউকে কিছু বলতে শুনি না!”

বাইরে শেষ নভেম্বরের নরম রোদ যথাসাধ্য মমতায় জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করছে ঘিঞ্জি, হতশ্রী, ধুলোমলিন, খোলা ড্রেনময় শহরটিকে। আর সি কে রাউলজীর অফিসের (নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কাটআউট খচিত) ভিতরের মেজাজ বাইরের আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গতি না রেখেই চড়া। সি কে রাউলজী, এই নির্বাচনী ক্ষেত্র থেকে আগের বারের বিজেপি বিধায়ক, এ বারেও লড়ছেন। জনতা দল থেকে কংগ্রেস হয়ে বিজেপি — প্রতিটি দল তাঁর উপস্থিতিধন্য। বিভিন্ন দল থেকে জিতেছেন মোট ছ’বার। তবে অন্য যে কারণে তিনি সারা দেশে আলোচিত, তা বিলকিস-মামলার অভিযুক্তদের সম্পর্কে করা মন্তব্যের কারণে। বিলকিসের ধর্ষকদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিবেচনার জন্য গুজরাত সরকার যে কমিটি গঠন করেছিল তাতে ছিলেন রাউলজী। বলেছিলেন, “ধর্ষণ যাঁরা করেছেন, তাঁরা সকলেই ব্রাহ্মণ এবং তাঁদের ভাল সংস্কার রয়েছে!”

তাঁর দলীয় অফিসে রাউলজীর হয়ে ব্যাট করছেন কেতনভাই। যিনি ক্ষমতার আড়ে-বহরে রাউলজীর চেয়ে বড় বই ছোট নন। অথচ ইনি বিজেপি-তে আছেন আবার কোনও নির্দিষ্ট পদে নেই! রাউলজী গ্রামে-গ্রামে জনসভায় দৌড়চ্ছেন, রাজ্য সমবায় সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান কেতনভাই দলের অফিসে আসর গরম রাখছেন। তাঁর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার্থেই বোধহয় রয়েছেন গুড়ের মতো মিঠে বচনের দিলীপ দসাদিয়া। ইনি বিজেপির গোধরা শাখার প্রধান। এঁরা দু’জন ঘাঁটিতে বসে ধর্ষকদের মুক্তির ঢাল রচনা করছেন এবং গোধরায় বিকাশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।

কুড়ি বছর ধরে গুজরাত দাঙ্গার সময়ে ধর্ষিত বিলকিসের জন্য যে ভাবে উদ্বেগ দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষ, এই ধর্ষকদের মুক্তি কামনা যে সে ভাবে করেনি, সেটা আমতা আমতা করেও ওই প্রবাল প্রতাপশালী স্থানীয় নেতাদের সামনে বলতেই হল। ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া এক বিষয়, কিন্তু তাদের কাজকে মান্যতা দেওয়া?

“যাঁরা ব্রাহ্মণ, তাঁরা তো সংস্কারী হবেনই। মধ্যে বড় কথা কী? এই নিয়ে এত অবাক হচ্ছেন কেন আপনারা?”— ভেসে এল পাল্টা যুক্তি। ধর্ষণকে বৈধ করতে ব্রাহ্মণত্বের এ হেন যুক্তিকাঠামো তৈরি করে দেওয়ায় অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বিশেষত এই শহরটিতে দাঁড়িয়ে, যেখানে কুড়ি বছর আগের জ্বলন্ত ট্রেনের অভিঘাত নতুন করে গোটা দেশে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলেছিল। তবে মুখ হাঁ করে দেওয়া যুক্তিটি এল এর পরে। স্মিতমুখ বিজেপি প্রধান দিলীপ দসাধিয়া বললেন, “রাজীব গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রকারীকেও তো ছেড়ে দেওয়া হল। ক্ষমা পরম ধর্ম।”

এর আগে দেড়ঘন্টা উজিয়ে দাহোড়ের রাধিকপুরগ্রামে গিয়ে দেখে এসেছি সপরিবার বিলকিস বানো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা কোথায়, কেউ জানেন না। বা সাংবাদিকদের বলতে চান না, তাঁর নিরাপত্তার আশঙ্কায়। তবে ঠারেঠোরে জানা গেল, এই ‘গ্যাং অব ইলেভেন’ মাঝেমধ্যেই হাজত থেকে বেরিয়ে বহাল তবিয়তে এলাকায় আড্ডা জমাতো। তখন ত্রাসে বারবার গ্রাম ছাড়তেন বিলকিসরা। আর এখন এই ভোটের বাজারে লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন অপরাধের শিকার, বুক ফুলিয়ে ঘুরছে অপরাধীরা।

তবে দিল্লি তথা সারা দেশে এই বিষয়টি নিয়ে যত প্রশ্ন, তার সিকিভাগও দেখা যাচ্ছে না এলাকায়। দু’লাখ আশি হাজারের এই নির্বাচনী ক্ষেত্রে দু’লক্ষের উপর হিন্দু ভোটার বলেই কংগ্রেস খুঁচিয়ে ঘা করতে অনাগ্রহী। এমনিতেও তাদের নেতা কর্তাদের বিশেষ দেখা যাচ্ছে না রাস্তাঘাটে। হাত চিহ্নের পোস্টার খুঁজতে গোয়েন্দা লাগানোর জোগাড়!

হিন্দু এবং মুসলিম খোপ কাটা কাটা এই জনপদ। এখানে সারি দিয়ে বিশাল লোহার চাটুতে মাংসের ছোট ছোট কাবাব তৈরি হচ্ছে। সুপ্রাচীন রাণী মসজিদের লাগোয়া। পায়ে হেঁটে আধ মাইল গেলেই ওখানে আবার গাঁদা ফুল আর সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো দেবদেবীর ছবির দোকান। বিশাল স্বামী নারায়ণ মন্দির। পাশে ক্ষেমচন্দ্র জিলানির শাড়ির দোকানের গদিতে বসে বৃদ্ধ বলছেন, “রাউলজী ভাল লোক। এ বার বিজেপি-ই জিতবে। ৯৯ শতাংশ সম্ভাবনা, লিখে নিন। বিলকিসের নামই শুনিনি আমরা। কি হয়েছে জানি না। বুঝিয়ে বলতেই তাঁর মন্তব্য, “শাড়ির ব্যাপারী আমরা, এতশত খোঁজ রেখে আমাদের লাভ কী?”

সত্যিই তো! গোধরার আদার ব্যাপারীদের প্রতিহিংসা, হিংস্রতা এবং ধর্ষণের সেই ঘটনার খোঁজ রেখে লাভই বা কি! কুড়িটা বছর তো দিব্যি কেটে গেল খোঁজ না রেখেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Bilkis Bano Gujarat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy