Advertisement
E-Paper

জাতপাতের গুজরাত ভোটে একা লড়ছেন রাজবীর, জয়ের বদলে অন্য লক্ষ্যে ‘নম্বরভাই’ অটোওয়ালা

এমনিতে আমদাবাদ মানে কাজের শহর। কিন্তু ভোট রাজনীতির খোঁজখবর নিলেই দেখা যাবে গোটা গুজরাতেই জাতপাত এক বড় অঙ্ক। সেখানেই দেখা মিলল জাতপাতহীন ‘নকল’ কেল্লার একা কুম্ভের।

বড় সম্পদের মালিক রাজবীর।

বড় সম্পদের মালিক রাজবীর। — নিজস্ব চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২২ ১২:৩৭
Share
Save

এই শহরে অনেক অটো। বড় বড় রাস্তায় হলুদ-সবুজ অটোর লাইন লেগে থাকে। কিন্তু তার মধ্যেই একটি অটো রয়েছে। যার চালক সত্যিই অনন্য।

গুজরাতের এক ‘চায়েওয়ালা’ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর রাজ্য গুজরাতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন। সেখানেই এক ‘অটোওয়ালা’-র খোঁজ মিলল। খোঁজ দিলেন অন্য এক অটোচালক। ভোটের কথা বলতে বলতে তিনিই জানালেন, গুজরাতের জাতপাত-নির্ভর নির্বাচনে গোটা রাজ্যে মাত্র এক জন মনোনয়নপত্রে নিজের জাত উল্লেখ করেননি। পেশায় তিনিও অটোচালক। নাম রাজবীর।

গান্ধীনগর দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দাখিল করেছেন রাজবীর। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট বলছে, আমদাবাদের খোড়িয়ারনগরে বাড়ি রাজবীরের। রাজবীরের ফোন নম্বরও পাওয়া গেল তাঁর দাখিল-করা হলফনামায়। ফোন ধরলেন। পরিচয় শুনে বললেন, বাড়িতে গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে না। গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দেখা হতে পারে। নবরংপুরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দেখা মিলল রাজবীরের।

স্পষ্ট জানালেন, নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজের পদবি এবং জাতের উল্লেখ করেননি। বাবার নামও লেখেননি। কারণ, বাবার নামে পদবি থাকলে সেটাও তো জাতেরই পরিচয়! মনোনয়নে স্পষ্ট লিখে দিয়েছেন, ‘‘বাবার নাম উল্লেখ করতে চাই না।’’ কেন? প্রশ্ন শুনেই হরিবংশ রাই বচ্চনের কবিতা শোনালেন রাজবীর। বাংলায় যার অর্থ, ‘কর্মের কুরুক্ষেত্রে রূপ, জাত, পিতৃপরিচয় কাজে দেয় না। কাজে দেয় শুধু জ্ঞান’।

কথা বলতে শুরু করলে অনর্গল রাজবীর। বলে গেলেন, ‘‘এখানে জাতপাতের বিচারে ভোট আমার একদম ভাল লাগে না। অনেক দিনই মনে হয়েছে, আমার নাম থেকে পদবিটা ফেলে দিই। সেই চেষ্টাও করে যাচ্ছি। এ বার ঠিক করলাম ভোটে দাঁড়াব। অনেক লোক না হলেও কিছু মানুষ তো এক গুজরাতির অন্য অস্মিতার কথা জানতে পারবে। যে শুধু নিজের নাম নিয়েই বাঁচতে চায়।’’ জাতপাতের বিপদ নিয়ে মনের কথা বলেই গেলেন, বলেই গেলেন। কিন্তু একটি বারের জন্যেও উল্লেখ করলেন না নিজের জাত। বরং বললেন, ‘‘কাজ দিয়েই আমি নিজের জাত চেনাতে চাই। এক দিন জিতবই।’’

মনোনয়নের হলফনামায় পিতৃপরিচয়ও গোপন রেখেছেন রাজবীর।

মনোনয়নের হলফনামায় পিতৃপরিচয়ও গোপন রেখেছেন রাজবীর। ছবি: সংগৃহীত।

‘ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার’ নামে খ্যাত আমদাবাদে গেলে গুজরাতের জাতপাতের বাড়বাড়ন্ত বোঝা যায় না। কাজ নিয়েই মশগুল শহর। নির্বাচনের প্রচারও নেই তেমন। মাঝেমধ্যে এক-আধটা বড় হোর্ডিং। শাসকের গেরুয়া ঝান্ডাও নয়। এই শহরে প্রচার হয় মূলত সন্ধ্যায়। তা-ও পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট সভা। এমনিতে জাতপাতের আঁচ না পাওয়া গেলেও নির্বাচনী রাজনীতির কথা উঠলেই শোনা যায় পটেল, কোলি, পতিদার, বানিয়া, মোধ, সিন্ধি মোধ, ধাবি-সহ নানা ভাগের কথা। রাজপুত, জাঠ ভাগও রয়েছে। এই সব ভাগকে যোগ করার ব্রত নিয়েছেন অটোচালক রাজবীর।

সুরেন্দ্র বলছিলেন, ‘‘নাম রাজবীর হলেও সবাই ওঁকে ‘নম্বরভাই’ বলে ডাকে।’’ কেন?

সে রাজবীরের অন্য লড়াইয়ের কাহিনি। যে লড়াই বছর আটত্রিশের রাজবীর শুরু করেছিলেন ২০১৫ সালে। শুধু জাত নয়, নাম দিয়ে যাতে ধর্মও না চেনা যায়, সেটাই ছিল লক্ষ্য। নিজের নাম বদলে যা রাখতে চেয়েছিলেন তা মূলত কিছু সংখ্যা। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় রাজবীরের ‘এনরোলমেন্ট নম্বর’ ছিল ‘আরভি১৫৫৫৬৭৭৮২০’। সেই নম্বরটিকেই নিজের নাম বানাতে চেয়েছিলেন। প্রথমে আমদাবাদের জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেন। নামবদল ও ধর্মের জায়গায় ‘নাস্তিক’ লেখার সে আবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হয় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে। সেখানেও আবেদন নাকচ হয়ে যায়। নামবদল না হলেও নাম বদলে যায় রাজবীরের। গুজরাটে কাউকে সম্মান দিতে নামের পরে ‘ভাই’ জোড়াই নিয়ম। যেমন, নরেন্দ্রভাই মোদী। সেই নিয়মে রাজবীরের ডাক নাম হয়ে গিয়েছে, ‘নম্বরভাই’।

এতে যে রাজবীর খুশি তা নয়। আসলে নামে এবং সমাজে পাকাপাকি বদলটাই তিনি চান। সেই চাওয়ার জন্যই ভোটে দাঁড়ানো। যে কেন্দ্রের প্রার্থী রাজবীর, সেখানে শেষ দু’বার জিতেছেন বিজেপির প্রার্থী ঠাকুর শম্ভুজি চেলাজি। এ বার জাতপাতের হিসাব বদলেছে। প্রার্থীও বদলেছে শাসক বিজেপির। উচ্চবর্ণের গান্ধীনগরে পদ্মের টিকিটে দাঁড়িয়েছেন অল্পেশ ঠাকুর। কংগ্রেসের প্রার্থী হিমাংশু ভি পটেল। একই সম্প্রদায়ের দৌলত পটেল প্রার্থী আম আদমি পার্টির। তাঁদের সঙ্গে লড়াই নিজেকে ‘নাস্তিক’ বলা রাজদীপের। নির্বাচনী প্রতীক ‘কম্পিউটার’।

জেতার আশা নিয়ে যে লড়ছেন না, সেটা জানিয়ে রাজবীর বললেন, ‘‘আমি আসলে আমার কথাটা সবাইকে শোনাতে চাই। প্রচার করছি না। আবার করছিও। আমার অটোয় যাঁরাই ওঠেন, তাঁদের বলি জাতপাতের বিরোধিতা কেন করা উচিত। তাঁরা অনেকেই আমার এলাকার ভোটার নয়। তবে আশা করছি কিছু ভোট পাব। গান্ধীনগর দক্ষিণে বহুজন সমাজ পার্টির ভোটটা পেলেও পেতে পারি।’’

অদ্ভুত জীবন তাঁর। ভাল পড়াশোনার ইচ্ছা ছিল। হয়নি। মনোনয়নের হলফনামায় ‘উচ্চমাধ্যমিক’ লিখেছেন। কিন্তু তিনি উত্তরপ্রদেশের এক বেসরকারি কলেজ থেকে সমাজবিদ্যায় স্নাতক হয়েছিলেন। পাশ করার পরে জানতে পারেন, ওই কলেজটির আদৌ কোনও স্বীকৃতি নেই। ফলে পাশ করলেও ডিগ্রি পাননি। সংসার জীবনও সুখের হয়নি। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা হয়নি। এখন মেয়েকে নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। রাজবীর বললেন, ‘‘এই অটোটা ভাড়ার। আগে তিনটে অটো ছিল আমার। কিন্তু করোনার সময় লকডাউনে তিনটেই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন ভাড়া নিয়ে পার্ট টাইম চালাই। আবার একটা বেসরকারি সংস্থায় ফ্লোর ম্যানেজারের চাকরিও করি। সেটাই লিখেছি হলফনামায়।’’

কমিশনকে দেওয়া হলফনামায় একটা মোটরসাইকেল আর কয়েক হাজার জমানো টাকার কথা লিখেছেন রাজবীর। যা হলফনামায় লেখেননি— তিনি অন্য ধনে ধনী। তাঁর সম্পদ তাঁর মনের জোর। গুজরাতের মতো একটি রাজ্যে সীমিততম সামর্থ্য নিয়েও তিনি ভোটের ময়দানে নেমেছেন রথী-মহারথীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। হারবেন জেনেও। এই লড়াইয়ের জোর সম্পদ নয়, তো সম্পদ কী!

Auto Driver election candidates Ahmedabad gujrat

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।