বিপর্যয়: এলজি পলিমার্সের রাসায়নিক কারখানায় গ্যাস লিকের ফলে অসুস্থ হয়ে পড়া এক শিশুকে নিয়ে দৌড় হাসপাতালের পথে। বৃহস্পতিবার বিশাখাপত্তনমে। ছবি- এএফপি।
৩৬ বছর আগে ভোপালের স্মৃতি উস্কে দিল বাঙালির প্রিয় পর্যটন শহর বিশাখাপত্তনম। ফের গ্যাস লিক, সময়টা এ বারেও মধ্যরাত পেরিয়ে। সে-বার অবহেলার তর্জনী উঠেছিল মার্কিন সংস্থা ইউনিয়ন কার্বাইডের দিকে, এ বার অভিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি। তার পরেও বিশাখাপত্তনমের ভয়াবহতা যে ভোপালকে ছুঁয়ে ফেলেনি, তার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা বাহবা দিচ্ছেন অন্ধ্রের পুলিশ-প্রশাসনকে।
অভিযোগ, ১৯৮৪-র ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে খবর পেলেও দিনের আলো ফোটার পরে খোঁজ নিতে এসেছিল মধ্যপ্রদেশ পুলিশ। তত ক্ষণে মারা গিয়েছেন অন্তত সাড়ে তিন হাজার মানুষ। অসুস্থ লাখখানেক। বুধবার রাত প্রায় আড়াইটেয় এলজি পলিমার্সের কর্মীরা বুঝতে পারেন, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাতাসে মিশে চলেছে বিষাক্ত স্টাইরিন বাষ্প। তখনই পুলিশে খবর দেন তাঁরা। লকডাউনের শেষ রাতে দুয়ার আঁটা পাড়ার প্রায় আড়াইশো বাড়িতে পুলিশের কড়া নাড়া। বিষ-বন্দি বেঙ্কটপুরম শুনে নেয়, প্রাণে বাঁচতে তখনই বাড়ি ছাড়তে হবে। হাজারখানেক মানুষকে কয়েক ঘণ্টায় সরিয়ে ফেলে প্রশাসন। তাই মৃতের সংখ্যা ১১। কিন্তু তার পরেও বিষবাষ্প গিলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৫০০ মানুষ। অসুস্থ হাজারখানেক।
স্টাইরিনের বিষক্রিয়া যে এত যন্ত্রণাদায়ক হয়, কারখানার শ্রমিকদেরও সেই ধারণা ছিল না বলে জানিয়েছে অন্ধ্র পুলিশ। পুলিশকে তাঁরা জানান, চোখ জ্বালা বা গা-বমির মতো উপসর্গটুকুই দেখা দিতে পারে। কিন্তু শ্বাসের সঙ্গে গ্যাস শরীরে ঢোকায় শ্বাসনালি ও ফুসফুসে তীব্র জ্বালার কথা জানিয়েছেন মানুষ। অনেকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন। গ্যাসে মৃত ও অসুস্থদের যে-ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছে, তা ভয়াবহ। রাস্তার পাশে দেহ ছড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণী মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ছেন জ্ঞান হারিয়ে। পুলিশ জানিয়েছে, এক মহিলা দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। দু’জন মারা গিয়েছেন কুয়োয় পড়ে। বহু পুলিশকর্মীও গ্যাসে অসুস্থ হয়ে সংজ্ঞা হারান। কয়েক কিলোমিটার দূরে সীমাচলম স্টেশনের রেলকর্মীরাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই রুটে সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। অন্য রুটে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ৯টি বিশেষ শ্রমিক-ট্রেন। রাতে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করেছে পুলিশ। কর্তৃপক্ষের দাবি, রেফ্রিজারেশন সিস্টেমের ত্রুটিতে সিলিন্ডারের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে তরল রাসায়নিকটি গ্যাসে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই ত্রুটি অনিচ্ছাকৃত। কারখানা বন্ধ না-থাকলে তা হয়তো আগেই ধরা পড়ত।
গ্যাস বৃত্তান্ত
• নিঃসৃত গ্যাস: স্টাইরিন। ইথেনিলবেঞ্জিন, ভিনাইলবেঞ্জিন, ফিনাইলইথেন নামেও পরিচিত।
• চরিত্র: বেঞ্জিন থেকে উদ্ভূত যৌগটি বর্ণহীন, মিষ্টি গন্ধযুক্ত। সাধারণ অবস্থায় তরল এই যৌগটি অত্যন্ত উদ্বায়ী। তাই ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। গ্যাসে পরিণত হওয়ার পরে অক্সিজেনের সংস্পর্শে জারিত হলে বিষাক্ত হয়ে ওঠে।
• গ্যাসের সংস্পর্শে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: চোখ, গলা, গায়ের চামড়ায় জ্বালা ও বমি ভাব। শ্বাসকষ্ট।
• দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব: মারাত্মক। শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বেশি পরিমাণে শরীরে ঢুকলে স্নায়ুতন্ত্রেও প্রভাব পড়ে। মাথা যন্ত্রণা, ক্লান্তি, কম শোনার মতো অসুখ হতে পারে। বিকল হতে পারে কিডনি।
• ক্যানসারের আশঙ্কা: যৌগটি ‘কার্সিনোজেন’ হিসেবে পরিচিত। মানুষের শরীরে ঢুকে অক্সিডেশন ঘটে ‘স্টাইরিন অক্সাইড’ তৈরি হয়। এটি বিষাক্ত, মিউটাজেনিক (যে রাসায়নিক জিনে বদল ঘটায়) ও কার্সিনোজেনিক (ক্যানসার তৈরি করে) হয়ে উঠতে পারে।
• স্টাইরিন উৎপাদন: ২০১৮-তে বিশ্বে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টন।
• কারখানাটিতে কী হত: স্টাইরিন ব্যবহার করে তৈরি হয় ‘পলিস্টাইরিন’। এটি এক ধরনের প্লাস্টিক। ফাইবারগ্লাস, রবার, মোম তৈরিতে লাগে।
• স্টাইরিন গ্যাস বিপর্যয়ের ইতিহাস: বিরল। ফলে এর সংস্পর্শে কী ক্ষতি হতে পারে, তার প্রমাণিত তথ্য নেই।
দুপুরে হাসপাতালে আসেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডি। মৃতদের পরিবারকে এক কোটি টাকা করে সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ফোন আসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের। তার আগেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করেন অমিত। দেশের শীর্ষ তিন নেতা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পদস্থ অফিসার এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা অধিকরণ (এনডিএমএ)-র কর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা তাঁদের জানান, স্থানীয় ব্যারাক থেকে এনডিআরএফ-এর একটি দল ভোরেই কারখানাটিতে পৌঁছে যান। তবে তার আগেই গ্যাস নিষ্ক্রিয় করা এবং লিক মেরামতির কাজ অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছেন শ্রমিকেরা। আপাতত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। লকডাউনে মাস খানেক বন্ধ থাকার পরে বৃহস্পতিবার কাজ শুরুর কথা ছিল এলজি কেমিক্যালসের অধীন পলিস্টাইরিন তৈরির কারখানাটির। বুধবার রাতে তার তোড়জোড়ের সময়েই অঘটন। গ্যাস লিক সম্পূর্ণ বন্ধ করতে গুজরাত থেকে একটি বিশেষ রাসায়নিক পিটিবিসি আনা হচ্ছে। দমন বিমানবন্দর থেকে ৫০০ কিলোগ্রাম পিটিবিসি হেলিকপ্টারে বিশাখাপত্তনমে উড়িয়ে আনার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র। পাশাপাশি দেশের সব রাসায়নিক কারখানাকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে— দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে খোলার সময়ে যাতে দুর্ঘটনা না-ঘটে, সতর্ক থাকতে হবে।
ভারতে গ্যাস দুর্ঘটনা
• ২ ডিসেম্বর, ১৯৮৪: মধ্যপ্রদেশের ভোপালে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডে গ্যাস লিক। মৃত্যু ৩৭৮৭ জনের। অসুস্থ ৫,৫৮,১২৫ জন।
• ১২ জুন, ২০১৪: ছত্তীসগঢ়ের ভিলাইয়ে সেলের মিথেন গ্যাস পাইপলাইনে লিক। দুই ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার-সহ ৬ জনের মৃত্যু। ৫০ জনের বেশি অসুস্থ।
• ২৭ জুন, ২০১৪: অন্ধ্রপ্রদেশের নাগরামে গ্যাস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার পাইপলাইনে বিস্ফোরণ। মৃত ২৯, আহত ১০।
• ১৭ নভেম্বর, ২০১৬: কর্নাটকের মেঙ্গালুরুতে এইচপিসিএলের প্ল্যান্টে গ্যাস লিক। তার জেরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির বহু বাসিন্দা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
• ১৫ মার্চ, ২০১৭: উত্তরপ্রদেশের কানপুরে একটি হিমঘরে অ্যামোনিয়া গ্যাস লিক। মৃত ৫, আহত অনেকে।
• ১৩ এপ্রিল, ২০১৭: গুজরাতের পোর গ্রামে একটি পানীয় জলের ট্যাঙ্কে ক্লোরিন গ্যাস সিলিন্ডারের ভাল্ব লিক। ২০ জন অসুস্থ।
• ৬ মে, ২০১৭: দিল্লির তুঘলকাবাদে একটি কন্টেনার ডিপো থেকে ক্লোরোমিথাইল পিরিডিন লিক হয়ে ৪৫০ জন স্কুল ছাত্রী অসুস্থ।
• ১৬ মে, ২০১৭: কর্নাটকের বেলুরে একটি জল প্রকল্পে ক্লোরিন গ্যাস লিক। অসুস্থ হন ২৫ জন।
• ৯ অক্টোবর, ২০১৮: ছত্তীসগঢ়ের ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ। মৃত ১১, আহত ১৪।
• ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮: গুজরাতের ভালসাদে রাসায়নিক কারখানায় ক্লোরিন গ্যাস লিক। পাশের কাচ কারখানার ৪০ জনের বেশি কর্মী অসুস্থ।
• ৭ মে, ২০২০: বিশাখাপত্তনমে রাসায়নিক কারখানা থেকে গ্যাস লিক। মৃত ১১, অসুস্থ অন্তত ১ হাজার।
গ্যাস লিকের ঘটনায় অসুস্থ এক মহিলাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিশাখাপত্তনমে। এপি
রাজ্য প্রশাসন দাবি করেছে, গ্যাস লিক নিয়ে আতঙ্কের কারণ নেই। তবে কারও কারও মাথা ঘোরা বা গা-বমির মতো লক্ষণ দেখা যেতে পারে। গ্রেটার বিশাখাপত্তনম পুরসভা টুইটে জানিয়েছে, “অসুস্থতা অনুভব করলে ভিজে কাপড় বা মাস্ক ভিজিয়ে মুখ ঢাকুন। কলা-গুড় এবং দুধ খান, সুস্থ লাগবে।” অন্ধ্রের শিল্পমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, দোষারোপ না করে অসুস্থদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন তাঁরা। তবে এআইটিউসি-সহ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের দাবি— ভোপালের মতোই, মানুষের বাঁচা-মরা নিয়ে বিদেশি সংস্থাগুলির অবহেলার আর একটি নজির এলজি-র এই গ্যাস দুর্ঘটনা। কর্তৃপক্ষকে দায় এড়াতে দিলে চলবে না।
আরও পড়ুন: লিক হওয়া স্টাইরিন গ্যাসের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব আরও মারাত্মক! বলছেন বিশেষজ্ঞরা
আরও পড়ুন: ৩৬ বছর আগে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার স্মৃতি ফেরাল বিশাখাপত্তনম, কী ঘটেছিল সে দিন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy