Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Pranab Mukherjee

নোট পড়া শেষ করেই বাংলা উপন্যাসে মন

এটা তাঁর কাছে গর্বের বিষয় ছিল, বিদেশমন্ত্রকের যে সমস্ত অফিসারদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন বা করছেন, তাঁদের প্রত্যেককে নামে চেনেন।

মুয়াম্মর গদ্দাফির সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়। নভতেজ সারনার তোলা ছবি।

মুয়াম্মর গদ্দাফির সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়। নভতেজ সারনার তোলা ছবি।

নভতেজ সারনা (বিদেশ মন্ত্রকের প্রাক্তন মুখপাত্র, আমেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত)
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:২৪
Share: Save:

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ-সংবাদটি যখন প্রথম কানে এল, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। উনি ছিলেন যাকে বলে এক চিরস্থায়ী ব্যক্তিত্ব। ছোট্টখাট্টো চেহারা, কিন্তু বিপুল ব্যক্তিত্বপূর্ণ উপস্থিতি, প্রজ্ঞা আর স্থিতিশীলতার প্রতীক। তাঁর চলে যাওয়ার ফলে ভারত নিজের অতীতের সঙ্গেই সংযোগ হারাল। নিছক তাঁর রাজনৈতিক জীবনের কারণে এ কথা বলছি না। দেশ গঠনের ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য, সংসদের শিকড় খোঁজার পরিপ্রেক্ষিতে ছিল তাঁর অতীতবিহার। এ সবই তাঁর তালুবন্দি ছিল। প্রবাদপ্রতিম স্মৃতিতে ভর করে তিনি অনায়াসে সামনে নিয়ে আসতে পারতেন সঙ্কটকালে দেশনির্মাতাদের দেওয়া পথনির্দেশগুলিকে। নবীন রাষ্ট্রের বিভিন্ন দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময় রাষ্ট্রপিতাদের তৈরি করা সমাধানগুলিকে।

বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র হিসেবে ওঁর সঙ্গে বহু সফরে গিয়েছি। কাবুল থেকে ইসলামাবাদ, সোল থেকে চিন, সৌদি আরব থেকে মিশর। এই সব সফরেরই নির্দিষ্ট কাঠামো ছিল। যাওয়ার পথে সরকারি এমব্রায়ার জেট-এর চার কামরার এগজিকিউটিভ কেবিনে সামান্য কথাবার্তা হত। প্রণবদা পুরোপুরি ডুবে থাকতেন ফাইলবন্দি ব্রিফিং নোট-এ। সেটা শেষ হলে শাল জড়িয়ে বাংলা উপন্যাস খুলে বসতেন। তাঁর ব্রিফকেসে একটি না একটি উপন্যাস থাকতই। এক বার ওই কেবিনে অফিসারদের মধ্যে আমি একা, সোল যাত্রার সময়। সেই সফরে কোনও কারণে বিদেশসচিব নেই, ফলে আমি একেবারে তাঁর মুখোমুখি! বিমান ছাড়ার পর থেকে উসখুস করছি। বুঝতে পারছি না, গম্ভীরভাবে চুপ করে থাকব, নাকি মাঝে মধ্যে মন্তব্য করে কেবিনের পরিবেশকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা করব। শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকার সিদ্ধান্তই নিলাম, কেননা মনে হল উনি সেটাই চাইছেন। ফেরার পথে কিন্তু উনি থাকতেন অনেক হাল্কা মেজাজে, হাসিখুশি। সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি নিয়ে কথা বলতেন, মতামত জানতে চাইতেন। আমরা বুঝতে পারতাম সফর নিয়ে তিনি খুশি, যখন অফিসারদের প্রথম নামটি ধরে ডাকতেন। এটা তাঁর কাছে গর্বের বিষয় ছিল, বিদেশমন্ত্রকের যে সমস্ত অফিসারদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন বা করছেন, তাঁদের প্রত্যেককে নামে চেনেন। কিন্তু এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে, দশকের পর দশক কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নাম যখন তাঁর কন্ঠস্থ!

আরও পড়ুন: কোভিড-বেড়া মেনেই বিদায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে

এক বার লিবিয়া সফরে ত্রিপোলির পরিবর্তে আমরা গেলাম সির্তে ভূখণ্ডে। কারণ, আমাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেখানকার এক মরুভূমিতে মুয়াম্মর গদ্দাফির সঙ্গে বৈঠক করানো হবে। লিবিয়ার প্রোটোকল তাদের নিজস্ব ধাঁচের। বিদেশমন্ত্রী এবং তাঁর প্রতিনিধিদলকে গেস্ট হাউসে রেখে দেওয়া হয়েছে। বৈঠক কখন হবে তা নিয়ে একটাও কথা নেই। দেখি অন্যান্য ভিজিটররাও অপেক্ষা করছেন। প্রণবদা কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলেন। বই পড়লেন, টেলিভিশন দেখলেন। আমরা তো প্রমাদ গুনছি এই বুঝি ওঁর মেজাজ খারাপ হয়। শেষ পর্যন্ত সময় ধার্য হল। আমাদের মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হল একটি মলিন তাঁবুতে। সেখানে প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা! অবিচল বিদেশমন্ত্রী ফর্মাল পোশাক পরে, সাফারি পোশাক পরিহিত লিবিয়ার স্বৈরতন্ত্রী নেতার সঙ্গে বৈঠক করলেন। গদ্দাফির পাশে রাখা ছিল একটি ছোট রেডিয়ো, আর মশা মারার যন্ত্র! কোনও সরকারি ফোটোগ্রাফার সেখানে না থাকায় আমিই পকেট ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে নিই। আমরা কখনও এই নিয়ে কথা বলিনি, কিন্তু জানতাম প্রণব মুখোপাধ্যায় সাহিত্যপ্রেমী। জেরুসালেমের উপর আমার লেখা বইটি তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম তাঁর ইজ়রায়েল সফরের আগে।তাঁর যে ‘ইন্ডিয়ান্স অ্যাট হেরোডস গেট’ নামের ওই বইটি ভাল লেগেছে তা বুঝতে পারি পরে। আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসাবে রওনা দেওয়ার আগে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে বেশি কিছু বলেননি তিনি সেদিন। কিন্তু বলেছিলেন, ‘তোমাকে শুধু এটাই বলতে চাই, সব সময় লেখাটা চালিয়ে যাবে ….।’

আরও পড়ুন: উনি বললেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত, আমার কপাল’

এই অত্যন্ত ভদ্র এবং বুদ্ধিমান মানুষটি আর রইলেন না। সেই সুশিক্ষিত এবং সাংস্কৃতিক মননটি আর রইল না। ভারতের প্রকৃত এই সন্তানটি আর রইলেন না।

অন্য বিষয়গুলি:

Pranab Mukherjee Death Congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy