দেশের ফ্লোরাইড-দূষণ মানচিত্রের অন্যতম বিপজ্জনক জায়গা পলামু। প্রতীকী ছবি।
স্বাধীনতার বয়স ৭২ পেরিয়েছে।
কিন্তু চকরুটোলায় কোনও বাহাত্তরের দেখা মিলবে না।
‘‘৭২-তো অনেক। ৫০ পার হলেই এখানকার মানুষ খাটিয়ায় লেপ্টে থাকেন।’’ বললেন সোহর সিংহ। টোলায় ঢুকতেই দেখা ৪৮ বছরের সোহরের সঙ্গে। কোমর, দু’টো পা বেঁকে, ফুলে উঠেছে। দু’হাতে দুটো লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেন। বলেন, ‘‘এক বার খাটিয়া নিলে বছর দু’য়েকের মধ্যেই সব শেষ। ভয়ে এই এলাকায় মেয়ের বিয়ে দেন না বাইরের মানুষ। এখানকার মেয়েদেরও শাদি হয় না অন্যত্র।’’
এই চকরুটোলা ডালটনগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে। কোয়েল নদী থেকে তিন কিলোমিটার দূরের কৌড়িয়া পঞ্চায়েতের এই টোলায় বাস করেন হাজার তিনেক আদিবাসী। টোলায় এমন কোনও বয়স্ক মানুষ নেই, যিনি সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন। চল্লিশের উপরে সকলের হাতে লাঠি। শিশুদের দাঁত হলুদ বর্ণের।
সৌজন্যে ফ্লোরাইড। সহনমাত্রার অন্তত চার গুণ বেশি (৪.২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে) ফ্লোরাইড মিশ্রিত বিষ-জল খেয়ে টোলার প্রতিটি পরিবারেরই কেউ না কেউ পঙ্গু। ফ্লোরাইড বিশেযজ্ঞরা জানান, শুধু চকরু-ই নয়, পলামু জেলার ৪৮টি গ্রাম আর গরওয়া জেলার ২৭৭টি গ্রামের ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রায় ফ্লোরাইড রয়েছে। দেশের ফ্লোরাইড-দূষণ মানচিত্রের অন্যতম বিপজ্জনক জায়গা পলামু।
চকরুটোলার আদিবাসীদের কাজ বলতে দিনমজুরি। সোহর সিংহ আগে সেই কাজ করতেন। স্ত্রী শকুন্তি দেবী ফ্লুরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন বছর তিনেক আগে। পাশের ঘরে অনিতা কুঁয়ারের বয়স ৪৫। খাটিয়ায় শুয়ে। তাঁর ভাগনে শিবকুমার বলেন, ‘‘এই খাটিয়ায় শুয়ে থেকেই দু’বছর আগে মারা গিয়েছেন অনিতার স্বামী দশরথ ওঁরাও। উনি ৫০ পার করতে পারেননি।’’
লেখাপড়া জানেন বছর তিরিশের যুবক রাজেশ চেরো। বললেন, ‘‘এখানকার মানুষ জানেন, তাঁদের আয়ু পঞ্চাশেই শেষ।’’ হাঁটুতে ব্যথা শুরু হওয়ায় খুঁড়িয়ে হাঁটেন। বললেন, ‘‘ঝাড়খণ্ড তৈরির আগে, অন্তত বছর ২৫ আগে বিহার সরকার এই সমস্যার সমাধানে কোয়েল থেকে জল তোলার ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল। আশপাশের কয়েকটি গ্রাম সেই ট্যাঙ্ক থেকে জল পেলেও পান না চকরুটোলার মানুষ।’’ কারণ, ট্যাঙ্কের উচ্চতা থেকেও চকরু গ্রাম আরও উঁচুতে। সেখানে জল তোলার জন্য চাই আরও একটি প্রকল্প। রাজেশ বলেন, ‘‘সেই প্রকল্প তৈরির জন্য বছরের পর বছর সরকারের কাছে দরবার করেছি। কিন্তু ফল হয়নি।’’
চকরুটোলায় ভোটের প্রচারে বিজেপি-র নেতারা এসে রামমন্দির তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন। গত পাঁচ বছরে তাঁদের আমলে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের কত উন্নয়ন হয়েছে, তার ফিরিস্তিও দিয়েছেন। কংগ্রেস নেতারাও বলেছেন, ক্ষমতায় এলে সব পরিবারকে বছরভর টাকা দেবেন।
সব শুনেছেন সোহর সিংহেরা। শুনেছেন, ভোটকেন্দ্রে তাঁদের মতো প্রতিবন্ধীদের মোটরবাইকে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মিলেছে ভোটের পরেই দূষণহীন জল সরবরাহ করার ‘পোক্ত’ প্রতিশ্রুতি।
সোহরেরা তাই ভোট দিতে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy