Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Jnaneswari Express

জ্ঞানেশ্বরী: নিশানায় রেলও

সিবিআই সূত্রের খবর, কী ভাবে এই জালিয়াতি করা হল এবং কোন কোন সরকারি অফিসার চৌধুরী পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন, সেটাই জানার চেষ্টা চলছে।

আটক অমৃতাভ।

আটক অমৃতাভ। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২১ ০৬:০৫
Share: Save:

কাদম্বিনী না-হয় ‘মরিয়া প্রমাণ’ করেছিল যে, সে ‘মরে নাই’। কিন্তু জীবিত অমৃতাভ চৌধুরী কী ভাবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজেকে ‘মৃত’ বলে ‘প্রমাণ করে এলেন’ এবং সেই সুবাদে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাঁর বোন মহুয়া পাঠক কী ভাবে একের পর এক বাধা টপকে রেলে চাকরি পেলেন, সেই ধাঁধার সুরাহা এখনও করতে পারেননি গোয়েন্দারা!

এর পিছনে যে মোক্ষম একটা জালিয়াতি আছে, সেটা বুঝতে গোয়েন্দা না-হলেও চলে। এ ক্ষেত্রে সিবিআই অফিসারদের সন্দেহ, এই জালিয়াতিতে অভিযুক্ত অমৃতাভ চৌধুরী এবং তাঁর পরিবার শুধু নয়, রেলের একাংশও জড়িত। কারণ, সরকারি চাকরি পাওয়া সহজ নয়। কাঠখড় পোড়াতে হয় বিস্তর। ধাপে ধাপে সেই কাঠখড় পুড়িয়ে অভিযুক্তের বোন যে রেলে চাকরি পেয়েছেন এবং ১০ বছর ধরে সেই চাকরি করেও চলেছেন, এটাই হতবাক করে দিয়েছে তদন্তকারীদের। কার দেহ অমৃতাভের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, উঠছে সেই প্রশ্নও। জ্ঞানেশ্বরী জালিয়াতি কাণ্ড আপাতত এমনই গোলকধাঁধায় জড়িয়ে।

সিবিআই জানায়, রেলের দায়ের করা এফআইআরে অমৃতাভ, তাঁর বোন মহুয়া পাঠক, বাবা মিহিরকুমার চৌধুরী এবং মা অর্চনা চৌধুরীর নাম রয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাতপরিচয় সরকারি কর্মীরা জড়িত বলে রেলের অভিযোগ। তদন্তে নেমে অমৃতাভ ও তাঁর বাবাকে রবিবার রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। তার পর বাবাকে ছেড়ে দিলেও অমৃতাভকে আটক রাখা হয়েছে। তাঁকে জোড়াবাগানের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কিছু নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করেন গোয়েন্দারা।

সিবিআই সূত্রের খবর, কী ভাবে এই জালিয়াতি করা হল এবং কোন কোন সরকারি অফিসার চৌধুরী পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন, সেটাই জানার চেষ্টা চলছে। কয়েক জন রেল অফিসারকেও তলব করতে পারেন গোয়েন্দারা। সিবিআই সূত্রের দাবি, অমৃতাভ রেলের কাছ থেকে নেওয়া ক্ষতিপূরণের টাকা সুদ-সহ ফেরত দেবেন এবং তাঁর বোন চাকরি ছেড়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।

জোড়াবাগানের গঙ্গানারায়ণ দত্ত লেনের সরু নোংরা গলিতে একটি পুরনো বাড়ির তেতলায় অমৃতাভদের বসবাস। রবিবার বেলা আড়াইটে নাগাদ সিবিআই অফিসারেরা অমৃতাভকে নিয়ে সেই বাড়িতে যান। সেখানে রুমালে মুখ ঢেকে অমৃতাভ অবশ্য নিজের দোষ এড়িয়ে যেতেই চেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করে অমৃতাভের বক্তব্য, তাঁর নাম করে বোন চাকরি করছেন, এ কথা তিনি জানতেনই না। এ ব্যাপারে তাঁর পরিবারের লোকেরাই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন বলে জানান তিনি। অমৃতাভের পরিবার কিছুই বলতে রাজি হয়নি। রেল সূত্রের দাবি, গত প্রায় ১০ বছর ধরে অমৃতাভ কার্যত গা-ঢাকা দিয়ে ছিলেন। তিনি কোথায় ছিলেন, কী করতেন, তারও সদুত্তর অমৃতাভ দেননি। অমৃতাভের হালহকিকত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন ওই এলাকার বাসিন্দারাও।

অমৃতাভের আদি বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের মন্তেশ্বরের বামুনপাড়া গ্রামের খাঁপুরে। এখনও সেখানে তাঁর আত্মীয়স্বজন থাকেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মন্তেশ্বর বাজার এলাকায় প্রোমোটিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন অমৃতাভ। সেই সূত্রে গত বছর দেড়েক মাঝেমধ্যে এলাকায় যাতায়াতও করতেন।

জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডে এখনও স্বজনদের দেহ শনাক্ত করতে পারেননি অনেকেই। মৃতদের স্বজনদের আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকত বলেন, ‘‘১৪৯ জন মৃত যাত্রীর মধ্যে ২৩ জনের মৃত্যুর শংসাপত্র পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর শংসাপত্র না-পাওয়ায় মৃতদের পরিবার নানা সমস্যায় পড়েছে। কয়েক জন আদালতের দ্বারস্থও হয়েছেন।’’ ওই ২৩ জনের পরিবারের কেউ ক্ষতিপূরণ হিসেবে রেলের চাকরি পাননি। জীবনবিমা-সহ নানা বিষয় আটকে রয়েছে জটিলতায়।

হাওড়ার সালকিয়ার বাসিন্দা প্রসেনজিৎ আটা তেমনই এক জন। রেলের অর্ডার সাপ্লায়ার ছিলেন প্রসেনজিৎ। তাঁর স্ত্রী যূথিকা বলেন, ‘‘একমাত্র মেয়ে পৌলোমী একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। চাকরির জন্য অনেক ছোটাছুটি করে এখন ক্লান্ত। অসুস্থ হয়ে হাঁটাচলা করতে পারি না। জীবিত মানুষ মৃত সেজে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা আজও সুবিচার পেলাম না।’’ তিনি জানান, ডিএনএ টেস্টের জন্য তাঁর শ্বশুর ও ননদের রক্ত নেওয়া হয় দু’বার। কিন্তু দেহ শনাক্ত হয়নি।

কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট থানা এলাকার বাসিন্দা সুরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী নীলম এবং দুই ছেলে রোহিত ও রাহুল সে-দিন জ্ঞানেশ্বরীর সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত কামরায় ছিলেন। রোহিতের দেহ শনাক্ত হলেও রাহুল ও নীলমের দেহ আজও শনাক্ত হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সুরেন্দ্র এবং তাঁর শ্যালক রাজু সিংহ দু’বার রক্ত দিয়েছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

রেল সূত্রের খবর, দুর্ঘটনার দিন অমৃতাভ আদৌ জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে চেপেছিলেন কি না, সেটাও যাচাই করা হচ্ছে। এ দিন অবশ্য অমৃতাভ দাবি করেন, জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার রাতে তিনি সেই ট্রেনে ছিলেন। বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তনী, মহুয়া কী ভাবে শিয়ালদহ ডিভিশনের সিগন্যালিং বিভাগের চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ বা পুলিশি যাচাই পর্ব পেরোলেন, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রেলের সন্দেহ, চাকরি জালিয়াতি চক্র এই ঘটনায় যুক্ত ছিল। রেলের একটি সূত্রের দাবি, মূল অভিযোগে আধিকারিকদের নাম না-থাকলেও তাঁদের মোটামুটি চিহ্নিত করা গিয়েছে। এর পরে তদন্তকারীরা ওই অফিসার এবং অমৃতাভদের মুখোমুখি বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

এ-সবের মধ্যে আরও একটি প্রশ্ন চিন্তায় ফেলেছে রেলকর্তাদের একাংশকে। তাঁরা বলছেন, ক্ষতিপূরণের চাকরিতে এমন আরও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেনি তো?!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy