আসল বিপদটা মালুম হতে নোট-বাতিলের ১৩ দিনের মাথায় টনক নড়ল নরেন্দ্র মোদী সরকারের। ঘোষণা করল, পুরনো ৫০০ টাকার নোটেই সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে রবি চাষের বীজ কেনা যাবে।
রবি শস্যের বীজ বোনার মরসুমে হঠাৎ করে পুরনো ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। ব্যাঙ্ক-এটিএম থেকে প্রয়োজন মতো টাকা তোলা মুশকিল, সমবায় ব্যাঙ্কগুলিও পুরনো নোট বদল করতে পারছে না। এ সব নিয়ে হইচই হতেই মোদী সরকার বার্তা দিতে চেয়েছিল, কৃষকদের যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। ঘোষণা করা হয়, চাষিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে সপ্তাহে ২৫ হাজার টাকা তোলা যাবে। কিন্তু ওই ঘোষণাই সার! চাষিরা না কিনতে পারছিলেন বীজ, না সার। কারণ, ঊর্ধ্বসীমা বাড়ালেও আসলে গ্রামের ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরগুলি নগদের জোগানই দিতে পারছে না। তাই বাস্তবে কোনও লাভ হচ্ছে না বলে গ্রামের মানুষদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছিল বিজেপি সাংসদদেরও। সরকারকে তাঁরা জানান, অধিকাংশ চাষিরই গ্রামীণ ব্যাঙ্ক বা সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশে সমবায় ব্যাঙ্কগুলি পুরনো নোট বদল করতে বা জমা করতে পারছে না।
এরই পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রকের কর্তারা টের পান, রবি মরসুমের মুখে চাষিদের হাতে টাকা না এলে ভবিষ্যতে ঢের বড় সমস্যার মুখে পড়তে পারে দেশের অর্থনীতি। তাঁরা জানতে পারেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক কম জমিতে গম-ধান-জোয়ার-বাজরা চাষ হচ্ছে। যার ফলে রবি চাষের উৎপাদন কমে যেতে পারে। ধাক্কা খেতে পারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি।
দলের নেতাদের ও কৃষি মন্ত্রকের কাছ থেকে এই বিপদ-বার্তা পাওয়ার পরেই মোদী সরকার আজ ঘোষণা করল, চাষিরা এখন থেকে পুরনো ৫০০ টাকার নোটেই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ কিনতে পারবেন। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, মোদী সরকার বড়লোকদের কথা ভাবছে, চাষি-খেতমজুরের কথা ভাবছে না। পেট্রোল পাম্পে পুরনো নোট ব্যবহারের ছাড় দেওয়া হয়েছে। আজ বীজ কেনায় শুধু পুরনো ৫০০ টাকার নোট ব্যবহারে ছাড় দেওয়া হলেও, সার কেনায় সমস্যার কোনও সুরাহা হয়নি। কংগ্রেস নেতা আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘এ সব থেকেই স্পষ্ট, এত বড় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী মোদী কারও সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেননি।’’
পুরনো ৫০০ টাকার নোটে বীজ কিনতে পারলেই যে গ্রামে নগদ জোগানের সমস্যা মিটে যাবে, এমনটা মনে করছে না মোদী সরকারও। উত্তরপ্রদেশ-পঞ্জাবে ভোটের কথা মাথায় রেখে, কী করে জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে নগদের জোগান বাড়ানো যায়, তা খতিয়ে দেখতে এ দিন সন্ধেয় তাঁর দফতর ও অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কারণ, ঝুঁকিটা শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক আশঙ্কাও কম নয়। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, গ্রামের মানুষের হাতে নগদের অভাব ঘটলে শুধু যে কম জমিতে রবি চাষ হবে, তা-ই নয়। গ্রামে বিক্রিবাটাও কমে যাবে। দেশের অর্থনীতির সব থেকে বড় বাজার এখনও গ্রাম। সেখানে চাহিদা কমলে শিল্পে উৎপাদন ধাক্কা খাবে। এখন রবি ফসল কম জমিতে চাষ হলে, তার ফল টের পাওয়া যাবে এপ্রিলে। যখন ফসল উঠবে। কৃষি ও শিল্পে একসঙ্গে উৎপাদন কমলে, আর্থিক বৃদ্ধি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
রবি চাষের বর্তমান ছবিটা কেমন?
কষি মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, কেন্দ্র গত সপ্তাহেই রবি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেশি পরিমাণে রবি চাষে উৎসাহ দিতে। কিন্তু চাষিরা তাতেও উৎসাহিত হচ্ছেন না। গত সপ্তাহে যে পরিমাণ জমিতে রবি ফসলের বীজ বোনা হয়েছে, তা আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় ১.৬৫ শতাংশ কম। ১১ নভেম্বরের আগে পর্যন্ত গত বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি জমিতে গমের চাষ হয়েছিল। নগদের অভাবে সেই গতি থমকে গিয়েছে। ধান চাষ কমেছে ২.৩ শতাংশ। জোয়ার-বাজরার চাষ কমেছে ১১ শতাংশ। এ বছরের ডালের রেকর্ড উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডালের চাষ বেড়েছে মাত্র ৪.৬ শতাংশ।
সাধারণত নভেম্বরের মধ্যে গমের বীজ বোনার কাজ শেষ করতে হয়। কৃষি মন্ত্রক সর্বশেষ যে রিপোর্ট পেয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি গম উৎপাদন হয় যে রাজ্যে, সেই উত্তরপ্রদেশে এ বছর ৯৯ লক্ষ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত গম চাষ হয়েছে মাত্র ১৫ লক্ষ হেক্টরে। পঞ্জাবে লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ লক্ষ হেক্টর। বীজ বোনা হয়েছে মাত্র ২৪ লক্ষ হেক্টরে। হরিয়ানায় লক্ষ্যমাত্রা ২৫ লক্ষ হেক্টরের মধ্যে মাত্র ৮.৫ লক্ষ হেক্টরে গম চাষ হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ও পঞ্জাবের মতো রাজ্যে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হলে আসন্ন ভোটে যে তার মাসুল গুনতে হবে, তা বুঝতে পেরেই আজ নড়ে বসেছে মোদী সরকার। যদিও তাতে কাজ কতটা হবে তা নিয়ে ধন্দ রয়ে যাচ্ছে। চাষিরা সার কেনা ও চাষের অন্যান্য খরচ মেটানোর জন্য নতুন নোট কোথায় পাবেন— এমন বহু প্রশ্নেরই উত্তর মিলছে না এখনও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy