রাতটুকু কাটাতে বালির উপর শুয়েই চিরঘুমে চলে গিয়েছেন ওঁরা। হুড়মুড় করে ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে আসা ভিড়টা কীসের উপর দিয়ে চলেছে, খেয়ালই করেনি। কারও বুকের উপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে ভিড়, কারও শরীরের একাধিক পাঁজর ভেঙে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটিয়ে এগিয়ে গিয়েছে স্নান-মুখী জনতার ঢল! ইলাহাবাদের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল মতিলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজের অধীনস্থ স্বরূপরানি নেহরু হাসপাতালের এক ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন কথাগুলো। তখনই তাঁর কাছে খবর এসেছে, এক রোগীকে স্নানঘাট থেকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পথেই মৃত্যুর। ফোন রেখে নিরুপায় ভঙ্গিতে তিনি বললেন, “আরও এক জন! জরুরি চিকিৎসার জন্য রোজ শয়ে শয়ে রোগী আসছেন ত্রিবেণী সঙ্গম থেকে। এর মধ্যে অন্তত ১০ জন পথেই মারা যাচ্ছেন।”
তিনি ফিরে যান ২৯ জানুয়ারি রাতের ঘটনায়। ‘মৌনী অমাবস্যা’ উপলক্ষে সে দিন ত্রিবেণী সঙ্গমে প্রবল ভিড় জমে। রাত দুটো নাগাদ তড়িঘড়ি স্নান করতে গিয়ে পদপিষ্ট হন বহু মানুষ। তিনি বলেন, “মাঝরাতে ফোনে মেসেজ পাই, পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে। জরুরি ভিত্তিতে সব চিকিৎসককে হাসপাতালে ডাকা হয়েছে। দ্রুত কাজে যোগ দিয়ে দেখি, রাতভর শুধুই রোগী আসছেন।” তাঁর কথায়, “শুনে অবাক লেগেছিল, গুরুতর জখম এক রোগী মৃত্যুর আগে শয্যায় শুয়ে বলছিলেন, স্নানের সময় নাকি পেরিয়ে যাচ্ছিল। তাই তড়িঘড়ি এগোতে গিয়েই তিনি পায়ের নীচে চাপা পড়েছেন। সে রাতে, যে সেক্টরের ঘটনা, সেখানে ঘাটের দিকে যাওয়ার জন্য একটি রাস্তা খোলা রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভিড়ের চাপ বাড়তে থাকে ঘাটের কাছে লাগানো ব্যারিকেডের উপর। ওই ব্যারিকেডের পরেই বালির উপর রাতে লোক শুয়েছিলেন। ব্যারিকেড টপকে যেতে গিয়ে ভিড় সরাসরি তাঁদের উপর পড়ে! আবর্জনা ফেলার লোহার ড্রামে ধাক্কা লেগে অনেকে পড়ে যাওয়ায় পদপিষ্ট হওয়ার যে ঘটনা প্রচার করা হয়েছে তা হয়তো পুরোটা সত্যি নয়।”
এই হাসপাতালেরই সুপারের দায়িত্ব সামলানো অজয় সাক্সেনা জানান, এমন পরিস্থিতির কথা ভেবেই ১৩ জানুয়ারি কুম্ভ স্নান শুরুর আগেই স্বরূপরানি নেহরু হাসপাতালে আলাদা করে ‘মেলা ওয়ার্ড’ তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালের নতুন ভবনে তিন তলায় প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ বদলে তৈরি হয়েছে ৭০ শয্যার এই মেলা ওয়ার্ড। প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন রোগী সেখানে ভর্তি করানো হচ্ছে এবং ৩০ জন রোগীকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি রাতের ঘটনার পরে গুরুতর অসুস্থ ৬৬ জনের মধ্যে ৪০ জনকে ভর্তি করানো হয়েছিল এই ওয়ার্ডে।
এ দিন ওই মেলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে ৬২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। বেশির ভাগই ভর্তি হচ্ছেন, পেটের সমস্যা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে। জল পানের পরেই অনেকে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন বলে ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষারত রোগীর পরিবারের সদস্যদের দাবি। এমনই এক রোগী সাবিত্রী বিশ্বকর্মা। নাকে অক্সিজেনের নল গোঁজা মহিলার স্বামী সঞ্জয় দাবি করলেন, উত্তরপ্রদেশেরই সিদ্ধার্থনগর জেলা থেকে কুম্ভ স্নানে এসেছিলেন তাঁরা। সঞ্জয়ের কথায়, “স্নান সেরে একটা দোকান থেকে জল নিয়ে খায় সাবিত্রী। তারপর ফিরে যাওয়ার বাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বমি শুরু হয় ওর। হাসপাতালে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জলের থেকে হতে পারে বলে ভর্তি নিয়ে নেওয়া হয়েছে!” একই অবস্থা গুজরাতের সুরাত থেকে কুম্ভ স্নানে এসে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হওয়া সুরেশ ঝা-র। তাঁর পরিবারের দাবি, গঙ্গাস্নান করে ফেরার পথে হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে সুরেশের। তার পর থেকে টানা মলত্যাগের সমস্যা শুরু হয়। পরিবারের এক সদস্য বললেন, "জল থেকে হয়েছে বলা হচ্ছে। কবে বাড়ি যেতে পারব জানিনা।"
হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, “জল একটা কারণ তো বটেই। এক জায়গায় এত মানুষ এলে কী পরিস্থিতি হতে পারে ভাবুন। যাঁরা কোনও না কোনও কো-মর্বিডিটি নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। হাসপাতালে আসার পথেই রোজ এমন ১০ জনের মৃত্যু ঘটে যাচ্ছে।” এর মধ্যেই জরুরি বিভাগে খবর পৌঁছেছে সতীশ বেনুগোপাল নামে হায়দরাবাদ থেকে আসা এক ব্যক্তির মৃত্যুর। পরিবারের আরও দু’জনের সঙ্গে একটি মোটরবাইক ভাড়া নিয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই বাইকে সরাসরি ধাক্কা মারে একটি গাড়ি। হাসপাতালে নিয়ে আসার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালের কার্যনির্বাহী প্রিন্সিপাল বাৎসলা মিশ্র বললেন, ‘‘পথের যা পরিস্থিতি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারছেন না অনেকে। প্রায় ৬০ কোটি মানুষ একটা শহরে চলে এসেছেন। এই পরিস্থিতিতেও রাত-দিন খেটে যতটা সম্ভব চেষ্টা করা হচ্ছে।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)