ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা। —ফাইল চিত্র
‘...আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই সাদা মারণ গ্যাসের মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। সেই মেঘ জমাট হয়ে ভেসে থাকল ভূপালের আকাশে।...ঘুমের মধ্যেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলেন বহু মানুষ। অনেকে জেগে উঠে বমি করতে শুরু করলেন। সারা শরীর অবসন্ন হয়ে এল তাঁদের। চোখেমুখে জ্বালা। কীটনাশক তৈরির জন্য যে কারখানার সৃষ্টি, সেই কারখানাই কয়েকশো মানুষের করুণ মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল।...’— ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর রাতে ভোপাল গ্যাস বিপর্যয়ের পরে এমনই লেখা হয়েছিল তৎকালীন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়। বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দেওয়া ওই দুর্ঘটনার ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি দেশের স্মৃতি থেকে।
ওই বিপর্যয়ের প্রায় ৩৬ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, কীটনাশক, রাসায়নিক-সহ বিপজ্জনক (হ্যাজার্ডাস) বর্জ্যের বিপদ এখনও কাটেনি। বরং কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের তরফে সদ্য প্রকাশিত ‘কেমিক্যাল অ্যান্ড হ্যাজার্ডাস ওয়েস্ট’ সংক্রান্ত ‘হ্যান্ডবুক’ জানাচ্ছে, দেশে যত পরিমাণ বিপজ্জনক বর্জ্য তৈরি হয়, সেই তুলনায় ‘হ্যাজার্ডাস ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট, স্টোরেজ অ্যান্ড ডিসপোজ়াল ফেসিলিটিজ়’-এর (টিএসডিএফ) সংখ্যা নগণ্য। মন্ত্রকের সহায়তায় ‘সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল, এডুকেশন, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিইইআরএ)’ এবং বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ল স্কুল অব ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি’-র করা ওই গবেষণার তথ্য আরও বলছে, দেশের ১৩টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিপজ্জনক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনও রকম ব্যবস্থাই নেই। ছ’টি রাজ্যে টিএসডিএফ-এর স্থাপন এখনও প্রস্তাবের পর্যায়ে রয়েছে।
শুধু পশ্চিমবঙ্গেই বিপজ্জনক বর্জ্য উৎপাদনকারী সংস্থার সংখ্যা ৯০০-র বেশি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের তথ্য বলছে, এই রাজ্যে ২০১৬-’১৭ সালে ৮৫৮৪৮.৭৪ টন বিপজ্জনক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। অথচ টিএসডিএফ-এর সংখ্যা মাত্র এক! যা রয়েছে হলদিয়ায়। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘বিপজ্জনক বর্জ্যের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সারা দেশে। সে ক্ষেত্রে তার প্রক্রিয়াকরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো দরকার।’’
কেন সেই পরিকাঠামো দরকার, তার ব্যাখ্যা করে পরিবেশবিদেরা জানাচ্ছেন, রাসায়নিক উৎপাদনের নিরিখে বিশ্বে ভারতের স্থান চতুর্থ। কৃষিজাত রাসায়নিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই দেশ রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, বিশ্বে রাসায়নিক ‘এক্সপোজ়ার’-এর কারণে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৬ লক্ষ লোকের (২০১৬ সাল)। আবার অনিচ্ছাকৃত রাসায়নিক বিষক্রিয়ার (আনইন্টেনশনাল কেমিক্যাল পয়জ়নিং) ফলে বিশ্বে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের। রাজ্যের পরিবেশ দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘রাসায়নিক ও বিপজ্জনক বর্জ্যের সঙ্গে জড়িত, তা কোনও সংস্থাই হোক বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অথবা রাসায়নিক শিল্প, কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সহযোগিতায় প্রকাশিত ওই ‘হ্যান্ডবুক’ সবার কাজে লাগবে।’’
পরিবেশ দফতরের কর্তাদের একাংশ এ-ও জানাচ্ছেন, শুধু ভোপালই নয়। ভারতে রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত আরও দুর্ঘটনা ঘটেছে। সে ১৯৭৫ সালের চাষনালা খনি দুর্ঘটনা, ২০০২ সালে বডোদরায় ক্লোরিন ভরার সময়ে এক বেসরকারি সংস্থার ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণ বা ২০১৬ সালে মুম্বইয়ের একটি রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণই হোক না কেন।
প্রতিটি দুর্ঘটনাই যেন ছোট ছোট ভোপাল বিপর্যয়ের মানচিত্র তৈরি করেছে দেশ জুড়ে। যে বিপর্যয়ের দু’দিন পরে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল—‘হাওয়ায় বিষ নেই, শ্মশানের বিষণ্ণতা’। লেখা হয়েছিল— ‘হাওয়ায় বিষ মিলিয়ে যাওয়ার পরে ভূপাল শহরে এখন শ্মশানের বিষণ্ণতা। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে।...এখানে-সেখানে হচ্ছে গণদাহ। কোথাও চিতার আগুনে জ্বলছে শত শত মানুষের মরদেহ, আবার কোথাও সার বেঁধে কবর দেওয়া হচ্ছে অনেককে।...’
সংশ্লিষ্ট ‘হ্যান্ডবুকে’ এই বিপর্যয়কে উল্লেখ করা হয়েছে ‘আ কেস অব ইনএফিশিয়েন্ট ওয়েস্ট ডিজপোজ়াল’ হিসেবে। দেশের রাসায়নিক দুর্ঘটনা-সরণির পরিপ্রেক্ষিতে সবার এটুকুই আশা, তিন যুগের পুরনো ক্ষতের সামনে যেন আর দেশকে কখনও দাঁড়াতে না হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy